E-Paper

পথভোলা মেয়েকে বাড়ি ফেরাচ্ছে বাংলা

চৈত্রের পড়ন্ত রোদ ছড়িয়ে আছে সেহাগড়ির হাজরাপাড়ায়। একটা মোটরবাইক এসে দাঁড়ায়। বাইকে বসে তন্ময়। পিছনের আসনে সেই মেয়ে। গাঁয়ের পাঁচ জনে আজ যাকে দীপালি দেবী নামে চেনে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২০
দীপালি দেবী আমতার শিয়াগড়িতে প্রতিবেশী দের সাথে। ছবিঃ দীপঙ্কর মজুমদার।

দীপালি দেবী আমতার শিয়াগড়িতে প্রতিবেশী দের সাথে। ছবিঃ দীপঙ্কর মজুমদার।

গাঁয়ের পাঁচ জনে আজ তার নাম জানে। ন’মাস আগেও জানত না, যে দিন প্রথম উদ্‌ভ্রান্তের মতো সেই মেয়ে এসেছিল এই পাড়ায়।

বয়স হবে বছর তিরিশেক। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত মেয়েটা। উলোঝুলো পোশাক, গায়ে ছোপ ছোপ ময়লা। তিরিক্ষি মেজাজ। কখনও রাস্তায় গাড়ি থামানোর চেষ্টা করত। ঢিল ছুড়ত চলন্ত গাড়ির দিকে। কখনও আচমকা শুয়েই পড়ত রাস্তায়। ‘গেল গেল’ করে ছুটে এসে প্রায় গাড়ির চাকার তলা থেকে ওকে কোনও মতে বাঁচাত পাড়ার লোকগুলো। এক দিন মেয়েটার ছোড়া একটা ইট ঝনঝনিয়ে ভেঙে দিল উল্টোদিকের দোকানের শো-কেস। দোকানদার বেরিয়ে এসে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারলেন ওকে।

মেয়েটা কী বুঝল কে জানে। তবে তার গায়ে হাত তোলার জন্য ওই দোকানদারকেই দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে এল পাড়ার সেই লোকগুলো। সেই থেকে মানুষগুলোকে একটু একটু করে কাছে আসতে দিল ও। তারাই ওকে দেখে, খেতে দেয়। চোখে চোখে রাখে সারা ক্ষণ। গত ন’মাস ধরে এই মানুষগুলোই একটা অসম লড়াই লড়েছে। লড়ে জিতেছেও। হাওড়ার জয়পুরের সেহাগড়ির তন্ময় হাজরা, প্রকাশ মণ্ডলরা আজ তাই তৃপ্ত। তাঁদের এবং তাঁদের পরিবার-প্রতিবেশীদের মানবিক ছোঁয়াটুকুই ম্যাজিক করেছে। ওই মেয়েকে এখন আর মানসিক ভারসাম্যহীন বলে না কেউ। সে নিজের নাম জানে। মনে পড়েছে স্বামী-সন্তানদের নামও। মনে পড়েছে অতীত। এ বার তার নিজের সংসারে ফেরার পালা।

চৈত্রের পড়ন্ত রোদ ছড়িয়ে আছে সেহাগড়ির হাজরাপাড়ায়। একটা মোটরবাইক এসে দাঁড়ায়। বাইকে বসে তন্ময়। পিছনের আসনে সেই মেয়ে। গাঁয়ের পাঁচ জনে আজ যাকে দীপালি দেবী নামে চেনে। আলাপ এগোতেই যে মিটিমিটি হাসতে থাকে। ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’ হয়ে উঠতে দেরি হয় না। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে ধুলো মেখে পথে ঘোরার দিনগুলো।

গল্প এগোয়। দীপালিকে নিয়ে হাজরাপাড়ার লড়াইয়ের গল্প।

লুচি-সিঙাড়ার দোকানি প্রকাশ মণ্ডল হেসে বলেন, ‘‘দোকানদারের হাতে দীপালি যে দিন থাপ্পড় খায়, সে দিন আমাদের খুব খারাপ লেগেছিল। আমার দোকানে এসেও মাঝেমধ্যে ওই রকম করত। শেষে শীতকালে এক দিন গায়ে জল ঢেলে দেওয়ার ভয় দেখাই। পরের দিন থেকেই মেয়ের মাথা ঠান্ডা। এর পর থেকে আজ অবধি সকাল-বিকেল আমার দোকানে ওর চা আর জলখাবার বাঁধা।’’

প্রথম থেকেই দীপালির দেখভাল, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা এক রকম নিজেদের কাঁধেই তুলে নিয়েছিল তন্ময়ের পরিবার। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী চন্দ্রিমা বললেন, ‘‘শুরুর দিকে কত বার পোশাক ছিঁড়ে ফেলত। সবাই মিলে ওকে নতুন পোশাক দিতাম। ঋতুকালীন সময়ে ওকে যাতে কোনও হেনস্থার মুখোমুখি হতে না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হত। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ এক দিন নিজের বড় মেয়ের নাম ধরে কান্নাকাটি শুরু করায় আমাদের মনে হল ওর স্মৃতি ফিরে আসছে। খুব আনন্দ হল।’’

এক দিন দীপালিই সবাইকে জানিয়েছিলেন, তাঁর পুরো নাম দীপালি দেবী। স্বামী সন্তোষ শর্মার সঙ্গে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে থাকতেন তিনি। শিকড় বিহারে হলেও বাপের বাড়ি অসমে। অচেনা সাংবাদিককে দীপালিই নিজের গল্প বলেন, ‘‘স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ডিমাপুর থেকে ট্রেনে চেপে বসেছিলাম। এক জন আমাকে একটা ওষুধ খেতে দিয়েছিল। আর মনে নেই, কী করে এখানে এলাম। স্বামী আমাকে নিতে আসছেন। ডিমাপুর ফিরব। মেয়েদের কতদিন দেখিনি।’’

দীপালির দুই মেয়ে। চাঁদনি আর আর রাধিকা। তাদের নিয়েই সন্তোষ আজ, বুধবার সেহাগড়িতে আসছেন দীপালিকে নিতে। বিকেলে হাজরাপাড়ায় সদ্য তৈরি হওয়া শিবমন্দিরের সামনে জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে যেন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর আনন্দ! দীপালি চলে যাওয়ার আগে তাঁকে ইমিটেশনের গয়না, নতুন জামাকাপড়, কিছু টাকাপয়সাও দিয়েছেন তাঁরা। তন্ময়ের দেওয়া ট্রলিব্যাগে সব জমিয়ে রেখেছেন দীপালি।

অথচ অন্ধকার দিনগুলোয় দু’একটা হিন্দি শব্দ ছাড়া দীপালির কথাবার্তা প্রায় বুঝতেই পারতেন না তন্ময়রা। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তন্ময় বললেন, ‘‘তন্ময় বলছিলেন, ‘‘বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল ওর উপরে। স্মৃতি ফিরছে দেখে ওকে একটা পেন-খাতা দিয়ে বলেছিলাম, যা যা মনে পড়বে লিখে রাখতে। সেই খাতা থেকেই ওর স্বামীর ফোন নম্বর, ঠিকানা পেয়েছি।’’

সরকারি হোমে কেন পাঠানো হয়নি দীপালিকে? লুচি-সিঙাড়ার দোকানি প্রকাশ মণ্ডল বললেন, ‘‘আমাদের আস্থা ছিল না হোমের উপরে। এই কয়েকটা মাস ওর জন্য খুব সজাগ থাকতে হয়েছে সকলকে। তন্ময়ের বাড়ি থেকে রাস্তার মোড়ের বাইরে ওকে যেতে দেওয়া হত না।’’ এই বাড়তি সতর্কতার কারণও আছে। স্থানীয়েরা জানালেন, দীপালি সুস্থ হয়ে ওঠার পরে তাঁকে নিয়ে পালানোর ছক কষেছিল এক যুবক। স্থানীয়রাই সে ছক ভেস্তে দেন। আজ দীপালির একটা আস্তানা আছে স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডের ছাউনিতে। সিভিক ভলান্টিয়ার কার্তিক মালি বলছিলেন, ‘‘দীপালি বাসস্ট্যান্ডে ঘুমোতে গেলে খুব সতর্কথাকি আমরা।’’

এলাকাবাসীর সেই সতর্কতা চোখে পড়ছে প্রতি মুহূর্তেই। দীপালিকে রাস্তায় ঘুরতে দেখলেই কেউ না কেউ বলছেন, ‘‘অ্যাই, এখানে কী করছিস? বাড়ি যা।’’ বাড়ি বলতে বাসস্ট্যান্ডের ছাউনির ওই সংসার। তবে মাঝে মাঝেই তন্ময়ের বাড়িতে চলে যান দীপালি। এ দিনও বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেখানেই।

দীপালিকে বাড়ি ফেরাতে হ্যাম রেডিয়ো অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তন্ময়। ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগবিশ্বাস বললেন, ‘‘আমাদের কাজই হল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষদের আবার পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেহাগড়ির বাসিন্দারা দেখালেন, মানুষ আজও মানুষেরই জন্য।’’ বহু বছর আগে বাঙালির জন্য এমনই একটি গান গেয়েছিলেন ভূপেন হাজরিকা। ঘটনাচক্রে তাঁর রাজ্যেই দীপালির বাপের বাড়ি।

দিন গড়ায় সন্ধের দিকে। হাত নেড়ে দীপালি বলেন, ‘‘বাই বাই, ফির আইয়েগা।’’ জানিয়ে দেন, নিজেও আবার বেড়াতে বেড়াতে ফিরে আসবেন তাঁর এই নতুন ঠিকানায়। তাঁর ‘নতুন’ বাপের বাড়িতে।

বাংলার এককোণে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

woman Society Assam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy