E-Paper

প্রবীণদের জন্য গড়ে উঠুক এমন সমাজ, যা প্রত্যাশিত নিজেদের বার্ধক্যে

প্রবীণ নির্যাতন মানে শারীরিক অত্যাচারের পাশাপাশি মানসিক অত্যাচার বা অবহেলাও। বহু ক্ষেত্রেই সে সব ঘটে আমাদের অজানতে। সেই প্রবণতা বন্ধে ১৫ জুন তারিখটি পালিত হয় বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৭:৩০
ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক প্রবীণা। শনিবার, বাগমারি এলাকায়।

ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক প্রবীণা। শনিবার, বাগমারি এলাকায়। ছবি: সুমন বল্লভ।


বর্তমান সমাজে প্রবীণদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা আর নিপীড়ন ক্রমাগত বাড়ছে, আমরা তা দেখতে পাই না বা দেখতে চাই না! সেই সব অবহেলার প্রবণতা বন্ধ করতেই প্রতি বছর ১৫ জুন পালিত হয় বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস। এই দিনটি আমাদের হাতে আয়না ধরিয়ে দেয়— কী ভাবে বয়স্ক অভিভাবক, আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশীদের সঙ্গে আচরণ করি। সেই ব্যবহার প্রকারান্তরে নির্যাতন নয়তো?

প্রবীণ নির্যাতন মানে কিন্তু শুধু শারীরিক অত্যাচার নয়। হতে পারে মানসিক অত্যাচার, অবহেলা, আর্থিক প্রতারণা কিংবা নিঃসঙ্গ করে দেওয়া। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো ঘটে আমাদের অজানতে।

ভারতে প্রবীণ জনসংখ্যা বাড়ছে দ্রুত, কিন্তু তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা বাড়ছে কি? ‘লঙ্গিচিউডিনাল এজিং স্টাডি অব ইন্ডিয়া’ (এল এ এস আই)-এর প্রথম ধাপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫ শতাংশ প্রবীণ পরিবার বা পরিচিতের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। এর চেয়ে অনেক বড় সেই শূন্যতা— যেখানে অধিকাংশ প্রবীণই মুখ খোলেন না। কেন? সম্পর্ক হারানোর ভয়ে, সামাজিক লজ্জা বা আইনগত জটিলতার আশঙ্কায়।

বিশেষত যাঁরা ডিমেনশিয়া বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন, যাঁদের আর্থিক বা প্রযুক্তিগত সচেতনতা কম বা শারীরিক ভাবে নির্ভরশীল— তাঁরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। চিন্তার কথা হল— প্রবীণেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিত বোধ করেন যাঁদের ব্যবহারে, তাঁরা তাঁদেরই প্রিয় জন।

বহু সময়ে পরিজনেরাই বুঝতে পারেন না যে, তাঁরা প্রবীণদের মানসিক ভাবে আঘাত করছেন বা যত্ন থেকে বঞ্চিত করছেন। যেমন, অবিরত অভিযোগ করা, খারাপ ব্যবহার করা, চিকিৎসা না করানো, সময় না দেওয়া— এ সবই প্রবীণ নির্যাতনের মধ্যে পড়ে, অনেক সময়ে এই ব্যবহারগুলো অজানতেই হয়ে যায়।

যার প্রভাব পড়ে শারীরিক স্বাস্থ্যে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ও মৃত্যুর হারে। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁরা দীর্ঘদিন মানসিক বা সামাজিক অবহেলার শিকার, তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ‌্‌রোগ, আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ে। তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতাও হয়তো থাকে না, ফলে কষ্ট চুপিসারে থেকে যায়।

বহু ক্ষেত্রেই প্রবীণ নির্যাতনের লক্ষণ বুঝতে পারি না। কারণ আমাদের দৃষ্টিতে এটি গুরুতর সমস্যা নয়। অথচ, কিছু সাধারণ লক্ষণ যদি নজরে রাখি, তবে এই নির্যাতনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন, আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, অকারণে কান্না, অজানা ভয়, খাওয়ায় অনীহা, শরীরে বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন, আর্থিক লেনদেনে অসামঞ্জস্য, কিংবা বার বার চিকিৎসা নিতে আসা, কিন্তু কিছু না বলা। সচেতন চোখ, সংবেদনশীল মন আর কান খোলা থাকলেই বোঝা যায়, সব ঠিক নেই।

প্রবীণদের প্রতি এই ব্যবহার শুধু বাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে, পথেঘাটে, বাসে, ট্রেনে, স্টেশনে, ব্যাঙ্কে, অফিসে দৈনন্দিন জীবনে এ রকম ব্যবহার দেখা যায়।

ভারতের আইনগত পরিকাঠামোয় এই সমস্যার স্বীকৃতি রয়েছে। ‘মেন্টেনেন্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজ়েন্স অ্যাক্ট, ২০০৭’ অনুযায়ী, সন্তান বা উত্তরাধিকারীরা তাঁদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য দায়বদ্ধ। প্রবীণেরা জেলা ট্রাইবুনালের মাধ্যমে মাসিক ভরণপোষণের আবেদন করতে পারেন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারেন। তবে এই আইনের প্রয়োগ সীমিত। অধিকাংশ মানুষ আইনের কথা জানেন না, জানলেও প্রয়োগে ভয় পান। কিছু দিন আগে মুক্তি পাওয়া রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘সন্তান’ ছবিটি এই বিষয়টি সামনে এনেছে এবং এই আইনের ব্যবহারকেও তুলে ধরেছে।

সমস্যার সমাধান কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়। সমাধান করতে হবে সমাজিক ও পারিবারিক ভাবে এবং একসঙ্গে। প্রবীণদের সম্মান দেওয়া, মতামত শোনা, দৈনন্দিন সিদ্ধান্তে তাঁদের যুক্ত রাখা এবং সময় দেওয়া— এ সবই নির্যাতন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ছোট থেকেই বাবা-মা, দাদু-ঠাকুরমার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলে এই সমস্যা কমবে।

তাঁদের প্রয়োজনে কাউন্সেলিং, সাপোর্ট গ্রুপ বা সমাজসেবী সংস্থার সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। প্রবীণদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস জাগানো, ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ দেওয়া এবং তাঁদের স্বাস্থ্য ও আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা জরুরি।

বহু ক্ষেত্রে পরিচর্যাকারীর মনের ক্লান্তি, আর্থিক চাপ, নিজের অসুস্থতা বা সহানুভূতির অভাব থেকেও প্রবীণ নির্যাতন ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারিবারিক আলোচনা বা তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নেওয়া যায়।

প্রবীণদের অবজ্ঞা করা মানে নিজের শিকড় কেটে ফেলা। তাই আমাদের দায়িত্ব, প্রবীণদের পাশে থাকা, তাঁদের সম্মান রক্ষা করে জীবনের শেষ অধ্যায়কে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা। আজকের সমাজ যদি প্রবীণদের জন্য নিরাপদ হয়, তবে আগামিকাল আমাদের জন্যও নিরাপদ হবে। প্রবীণদের জন্য হোক এমন সমাজ, যা নিজেদের বার্ধক্যে প্রত্যাশিত— মর্যাদাপূর্ণ ও সহানুভূতিসম্পন্ন।

(মনোরোগ চিকিৎসক)।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

old Old Age

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy