Advertisement
E-Paper

অবক্ষয় আর অবলুপ্তির মাঝে বাংলার চালচিত্র

পুরনো খবরের কাগজ জুড়ে জুড়ে তৈরি অর্ধ গোলাকার একটা ক্যানভাস। তার উপরেই তুলির টানে, নানা রঙের ব্যবহারে ফুটে উঠছে বিভিন্ন দেবদেবীর অবয়ব। শিব, পার্বতী, কালী, চণ্ডী আরও কত কী! ক্রমেই তা রূপ নিচ্ছে রক্তবীজের সঙ্গে সিংহবাহিনীর যুদ্ধের, শিব-পার্বতীর সংসারের, রামাভিষেকের দৃশ্যের কিংবা কৃষ্ণলীলার। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটে।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:৫৩

পুরনো খবরের কাগজ জুড়ে জুড়ে তৈরি অর্ধ গোলাকার একটা ক্যানভাস। তার উপরেই তুলির টানে, নানা রঙের ব্যবহারে ফুটে উঠছে বিভিন্ন দেবদেবীর অবয়ব। শিব, পার্বতী, কালী, চণ্ডী আরও কত কী! ক্রমেই তা রূপ নিচ্ছে রক্তবীজের সঙ্গে সিংহবাহিনীর যুদ্ধের, শিব-পার্বতীর সংসারের, রামাভিষেকের দৃশ্যের কিংবা কৃষ্ণলীলার।

চলছে চালির ‘পট লেখা’। কিন্তু কালের স্রোতে চালচিত্র হারিয়েছে তার আভিজাত্য এবং শিল্প-সূক্ষ্মতা। দিনে দিনে উধাও হয়েছে তার সাবেক জৌলুস। আজ শুধু যেন নিয়ম রক্ষার্থে টিকে আছে চালচিত্র। চালচিত্র আসলে দেবীর বিগ্রহের প্রেক্ষাপটে শৈব, বৈষ্ণব এবং শাক্ত ধর্মের সমন্বয়। আজ মূলত সাবেক প্রতিমার চালিতে ব্যবহৃত হয় এই চালচিত্র।

দিনে দিনে কমে আসছে চালচিত্র-শিল্পীও। আর যাঁরা টিকে আছেন তাঁরা কোনও রকমে পেটের দায়ে ধরে রেখেছেন প্রাচীন এই শিল্পকে। পটশিল্পীদের মতে, সময়ের সঙ্গে সে ভাবে বাড়েনি পটের দাম। আর ক্রেতারাও চালচিত্রের জন্য বেশি খরচ করতে নারাজ।

কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণি এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে দেখা যায় এই পেশার কিছু শিল্পীকে। পুজোর আগে তাঁদের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাঁরা বায়নার কাজ শেষ করতে ব্যস্ত। এখনও এখান থেকেই চালচিত্রের পট যায় কলকাতায়, গোটা রাজ্যে, এমনকী ও পার বাংলার বিভিন্ন জেলায়। শিল্পীদের ভাষায়, এই পট আঁকা আসলে ‘পট লেখা’। পট লেখার এই কাজ চলে সারা বছর ধরেই। তবু অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন শিল্পীরা।

সে কারণেই পট লিখতে লিখতে প্রবীণ চালচিত্রশিল্পী স্বপন পালের খেদ, “একটা পট লিখে নাম মাত্র দাম মেলে। তার জন্য বেশি সময় দেওয়া যায় না। ভাল কাজ করলে ক্রেতারা তার দাম দিতে চান না। আর এই কারণেই জৌলুস হারিয়েছে চালচিত্র। এখনও বছরে প্রায় দু’হাজারের মতো পট লিখতে হয়। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এবং মফসসলে এর চাহিদা আছে।”

অন্য এক চালচিত্রশিল্পী রেবা পালের গলাতেও একই সুর। তাঁর প্রশ্ন, “প্রতি বছরই বাড়ছে রং ও আঠার দাম। আর্থিক অনিশ্চয়তার জন্য এই পেশায় শিল্পীর সংখ্যা কমে গিয়েছে। প্রতিমা কিংবা সাজের দাম যে হারে বেড়েছে পটের দাম কী সেই হারে বেড়েছে?” তিনি আরও জানালেন, কম রোজগারের জন্য নতুন কেউ এই পেশায় আসতে আগ্রহী নন। আজও একটি পটের দাম ৫০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকার মধ্যেই রয়েছে।

চালচিত্রে ব্যবহার করা হয় বিশেষ প্রাকৃতিক রং। যেমন সাদা রঙের জন্য খড়িমাটি ও চকখড়ি, হলুদ রঙের জন্য পিউরি, নীলের জন্য খেতের নীল, কালোর জন্য ভুষোকালি, লালের জন্য মেটে সিন্দুর ইত্যাদি। পটের মাপ তিন হাত থেকে সাত হাত পর্যন্ত হতে পারে।

পটের মতো আগে চালচিত্র-ও হত নানা রকম। এখন সাধারণত যে চালচিত্র আঁকা হয় তা মার্কিনি চালিতে ব্যবহৃত হয়। তবে মঠচৌড়ি, টানাচৌড়ি কিংবা সাবেক বাংলা চালের চালচিত্র হত নানা রকম। চালচিত্রে কোথাও কোথাও দেখা যেত অষ্টনায়িকা, দশমহাবিদ্যা, নবর্দুগা, চণ্ডীর কাহিনি, দশাবতার, কৃষ্ণলীলা কিংবা রামায়ণের ঘটনা। শুধু তাই নয় বাংলার এক এক প্রান্তের চালচিত্র হত এক এক রকম।

আগে সূত্রধররা (চালচিত্রের শিল্পী) বাড়ি বাড়ি গিয়েই প্রতিমার চালিতে পট লিখতেন। তার পরে প্রচলন হয় কাগজে পট আঁকার ট্রাডিশনের। আর এই কাগজে আঁকা পট চালচিত্রে আটকে দেওয়া হয়। তবে আজও বেশ কিছু পরিবারে প্রতিমার চালিতে পটলেখার ঐতিহ্য অটুট। খোদ কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ‘রাজরাজেশ্বরী’ দুর্গার চালচিত্রটি ব্যতিক্রমী। মাঝখানে থাকেন পঞ্চানন শিব, পাশে থাকেন পার্বতী। তার এক পাশে থাকে দশমহাবিদ্যা। অন্য দিকে দশাবতার।

তেমনই কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বৈষ্ণবদাস মল্লিকের বাড়ি বা হাওড়া রামকৃষ্ণপুরের বসু বাড়িতে আজও টিকে আছে চালিতে পট লেখার সেই ঐতিহ্য। উত্তর কলকাতার চোরবাগানের রামচাঁদ শীলের পরিবারে বিমানবিহারী শীল এই প্রসঙ্গে বলছিলেন, “আগে চালিতে পট লেখা হলেও ভাল চালচিত্র শিল্পী সংখ্যায় কমে যাওয়ায় এখন দেবীর চালচিত্রে ব্যবহার করা হয় হাতে আঁকা চালচিত্র।”

আজও কলকাতার বেশ কিছু বনেদি পরিবারে পট লেখেন কৃষ্ণনগরের বিশ্বনাথ পাল। তিনি বললেন,“বনেদি পরিবার আজও হাতে আঁকা পট পছন্দ করে। পুজোর আগে এখনও খিদিরপুর ও উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়িতে পট লিখতে যেতে হয়।”

তবে বাংলার সাবেক চালচিত্র কেমন দেখতে ছিল তা দেখতে হলে আজ ভরসা দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়। ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর কথায়: “চালচিত্র হত নানা রকম। যেমন মঠচৌড়ি চালির চালচিত্রে দেব দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নীচে, একটির নীচে আর একটি। আবার সাবেক বাংলা চালে সেগুলি থাক থাক করে আলাদা আলাদা প্যানেলে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালের পটে সেগুলি থাকে পাশাপাশি। গুরুসদয় সংগ্রহালয়ে রাখা দুর্গার চালচিত্র দেখে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে, কতটা সূক্ষ্ম কাজ করতেন তখনকার শিল্পীরা।

তবে আজ ছবিটা ভিন্ন। চালচিত্র আছে, তবে তার অবস্থান, অবক্ষয় আর অবলুপ্তি এই দু’য়ের মাঝে।

ছবি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য

pujo bibhutisundar bhattacharya chalchitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy