প্রথম লক্ষ্য, অভিযোগের সন্ধান। তার পরে দেখা, অভিযুক্ত নবান্নর বিরাগভাজন কি না। দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেলেই তাঁর কেল্লা ফতে!
এই ছকেই কখনও তাঁর শিকার কুণাল ঘোষ। কখনও গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তী, এবং সর্বশেষ সুমন মুখোপাধ্যায়। অভিযোগের গুরুত্বে তারতম্য থাকলেও অভিযুক্তকে নানা ভাবে হেনস্থা করার ‘দক্ষতা’য় তাঁর জুড়ি মেলা ভার!
লোকে বলে, বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষের এটাই ‘ইউএসপি’। আর সরকারের উপরতলায় তাঁর এই ‘কুশলতার’ কদর আছে বলেই তিনি অকুতোভয়।
এমনিতে সহকর্মীদের অনেকের কাছে সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্ভীক অফিসার হিসেবে পরিচিত তিনি। কিন্তু, তাঁরই ঘনিষ্ঠ মহলের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, প্রায় ৯-১০ জনকে টপকে বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান হওয়ার পরে এবং সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্ত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে তাঁর মধ্যে ‘পরিবর্তন’ এসেছে। আচরণে এসেছে ঔদ্ধত্য। এমনকী, সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের কর্তব্য ঠিক করে দেওয়ার কাজটাও তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন স্বঘোষিত অভিভাবকের মতো। তারই ফলে কোনও অভিযোগ হওয়ার আগেই সুমন মুখোপাধ্যায়কে থানায় ডেকে এনে বসিয়ে রাখার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না দেখিয়েই অর্ণববাবু চেয়ার ঠেলে উঠে শেষ করে দিতে পারেন সাংবাদিক বৈঠক। অবলীলায় বলতে পারেন, “যা করা হয়েছে তা আইন মোতাবেকই করা হয়েছে।”
রাজ্য পুলিশের পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে আইপিএস হওয়া অর্ণব কাগজেকলমে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের একাদশ ব্যাটালিয়নের কম্যান্ড্যান্ট। থাকার কথা পুরুলিয়াতে। রাজ্য সরকারের দেওয়া আইপিএসদের পোস্টিংয়ের সাম্প্রতিক তালিকাতেও এটা ছাপা আছে। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে তিনি সেখানে যাননি এক বারের জন্যও। সল্টলেক পুলিশ কমিশনারেট তৈরি হওয়া ইস্তক সেখানকার গোয়েন্দাপ্রধানের দায়িত্বই সামলাচ্ছেন। পাকাপাকি ভাবে বদলি গত দুই বছরেও হয়ে ওঠেনি। তবে ইতিমধ্যেই হিসাবের অঙ্ক সঠিক ভাবে কষে উপরমহলের সুনজরে চলে যাওয়ায় অর্ণব ঘোষের ঠাঁই বদল আপাতত দূর অস্ত বলেই মনে করেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা।
কলকাতায় সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখায় কয়েক বছর চাকরি করার সুবাদে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, তা সারদা-তদন্তে কাজে লাগিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন অর্ণব। ওই তদন্তে কিছুটা সফল হওয়ার জন্যই তিনি বিভিন্ন মহলের ঈর্ষার পাত্র হয়ে পড়েছেন, ঘনিষ্ঠ মহলে এমন আক্ষেপও করেছেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান। যদিও সবাই সে রকম মনে করেন না। তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষের অভিযোগ, সরকার ও ক্ষমতাবান কিছু মানুষকে বাঁচাতেই কাজে লাগানো হয়েছে অর্ণব ঘোষের ওই ‘অভিজ্ঞতা’-কে। সারদা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কুণাল এখন জেলে। আদালতে হাজির করানোর সময়ে তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ তুলে কুণাল তো অর্ণববাবুর বিরুদ্ধে বিধাননগর থানায় লিখিত অভিযোগও করেছেন।
সুমন মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন অর্ণব। কিন্তু ব্যাটে বলে হয়নি। অভিযোগকারী পাননি। তাই শিকার ফসকেছে। অভিযোগ জমা পড়ার পাঁচ ঘণ্টা আগেই অর্ণবের নির্দেশে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুমনকে। কিন্তু অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যে অভিযোগ পুলিশের হাতে এসেছিল, তার সাহায্যে গ্রেফতার করা যায়নি ওই নাট্যকার-পরিচালককে।
তবে এতেও দমে যাননি অর্ণব। জানিয়ে দিয়েছেন, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত হার মানতে যে তিনি নারাজ, সে কথাও বুঝিয়ে দিয়ে বলেছেন, “আমরা (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের) মেডিক্যাল রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। সেটা পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।” যার স্পষ্ট অর্থ, নবান্নর ‘অপছন্দের’ লোক সুমনকে সহজে ছাড়ার পাত্র তিনি নন। ঘনিষ্ঠ মহলে সুমন অবশ্য জানিয়েছেন, তিনি যে কোনও ধরনের তদন্তে সাহায্য করতে চান পুলিশকে।
শুধু সুমন কিংবা কুণাল নন। অভিযোগ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের থানায় ডেকে বা বাড়িতে নোটিশ পাঠিয়ে সরকারকে খুশি রাখার যে আপ্রাণ চেষ্টা অর্ণব চালিয়ে গিয়েছেন, তারই ধাক্কা লাগে সিপিএম নেতা গৌতম দেব ও সুজন চক্রবর্তীর গায়ে। সারদা-কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ‘থানায় হাজিরা দিতে হবে’ বলে রাতে গৌতমবাবুর বাড়িতে লিখিত নোটিশ দিয়ে আসার পরেও থানার রাস্তা মাড়াননি এই সিপিএম নেতা। ইত্যবসরে ওই মামলার তদন্তের ভার বিধাননগরের পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে সিবিআইয়ের হাতে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে, এখন থানায় আর যেতেও হবে না গৌতমবাবুকে।
লোকসভা ভোটের প্রচারে ব্যস্ত থাকা সুজনবাবুর বাড়িতে নোটিশ লটকে দিয়ে এসেছিল বিধাননগরের পুলিশ। সুজনবাবু বলছেন, “আমার বাড়িতে লটকে যাওয়া নোটিশ আজও রেখে দিয়েছি। কে বলেছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই! আছে তো! মনে মনে করা অভিযোগ!
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হচ্ছে প্রশাসনের কর্তাদের দিয়ে। তাই উপরওয়ালাদের কথায় তাঁরা এ সব করে বেড়াচ্ছেন।”
সুমনের ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল? সুমনকে রবিবার দুপুরে বিধাননগর দক্ষিণ থানা থেকে ডেকে পাঠানোর পরে তিনি বিকেল পাঁচটা নাগাদ থানায় পৌঁছোন। কিছু ক্ষণ বসিয়ে রাখা হয় তাঁকে। তার পরে কাছেই অর্ণববাবুর অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। রাত দশটার পরে নিউটাউন থানায় নিয়ে যাওয়া হয় সুমনকে। সেখানেই রাতে সুইসোতেল কর্তৃপক্ষের তরফে সিকিউরিটি ম্যানেজার রামবাহাদুর গুরুঙ্গ একটি লিখিত বিবৃতি জমা দেন।
কী সেই বিবৃতি? ২২ মে থেকে ২৪ মে সকাল পর্যন্ত সুমন ও অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় কখন হোটেলে ঢুকেছেন, কোন ঘরে ছিলেন এবং তাঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে ঘরে ভাঙা বোতল, প্লেট-গ্লাস এবং রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যায় বলে বিবরণ দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে। শেষ লাইনে বলা হয়েছে, ‘এর জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত করুক পুলিশ।’ হোটেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, কারও বিরুদ্ধে তাঁরা কোনও অভিযোগ করেননি। আইনজীবীদের অনেকেই তাই প্রশ্ন তুলছেন, ওই শেষ লাইনটি কি তবে পুলিশের চাপে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন রামবাহাদুর? কারণ, ওই একটি লাইনেই লুকিয়ে রয়েছে পুলিশের কার্যসিদ্ধির জিয়নকাঠি।
প্রাক্তন পুলিশ কর্তা এবং আইনজীবীদের অনেকেই একে পুলিশি অতিসক্রিয়তা বলে অভিযোগ করলেও তা মানতে চাননি অর্ণববাবু। তাঁর মন্তব্য, “অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
আর অর্ণববাবুকে ‘কাজে লাগানোর’ অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy