Advertisement
E-Paper

এফআইআরে কান্তির নাম, বিজেপিকেও তোপ মমতার

রায়দিঘিতে চার জনের খুনের ঘটনায় শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর। নিহতেরা সকলেই তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে সিপিএম-বিজেপি’র আঁতাঁতের অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার পরে রায়দিঘির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে এফআইআর-ও করা হয়েছে।

শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৪ ০৩:২০
ছকু মোল্লার বাড়িতে মুকুল রায়। রবিবার দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।

ছকু মোল্লার বাড়িতে মুকুল রায়। রবিবার দিলীপ নস্করের তোলা ছবি।

রায়দিঘিতে চার জনের খুনের ঘটনায় শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর। নিহতেরা সকলেই তৃণমূল কর্মী বলে দাবি করে এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে সিপিএম-বিজেপি’র আঁতাঁতের অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনার পরে রায়দিঘির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে এফআইআর-ও করা হয়েছে। যদিও কান্তিবাবুর দাবি, তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে। আর বিজেপি-র দাবি, তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিণামেই এমন ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশ সূত্রে খবর, শনিবার রাতে একটি সালিশি সভা থেকে ফেরার পথে খুন হন চার জন। নিহতদের মধ্যে আতিয়ার মোল্লা (৩২), হাসান গাজি (৩৫) ও হাফিজুল গাজি (৪০) এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসাবে পরিচিত। আর এক নিহত ছকু মোল্লাকে (৩৫) তৃণমূল তাদের কর্মী বলে দাবি করলেও নিহতের স্ত্রী আজমিরা বিবি বলেন, “আমার স্বামী ও পরিবারের সকলেই সিপিএম সমর্থক।” পুলিশ জানিয়েছে, নিহত হাসান ও হাফিজুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় খুন, ডাকাতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার পরে শনিবার রাতেই কান্তিবাবু-সহ ২১ জনের বিরুদ্ধে রায়দিঘি থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে নাম রয়েছে জেলার সিপিএম নেতা বিমল ভাণ্ডারী এবং মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির মৎস কর্মাধক্ষ্য ফারুক হোসেন মোল্লারও। ঘটনায় রবিবার চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের নাম ছাদিম পেয়াদা, জাহাঙ্গির হোসেন মোল্লা, অভিমন্যু সর্দার এবং আবু তালেব পাইক। ডায়মন্ড হারবার আদালতের বিচারক চার জনেরই ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠির বক্তব্য, “অভিযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

পুলিশমন্ত্রী মমতা অবশ্য এ দিনই রায়দিঘির ঘটনার প্রেক্ষিতে সিপিএম এবং বিজেপি-কে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তৃণমূলের টুইটার হ্যান্ডলের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য, “বিজেপি এবং সিপিএম রাজ্যে সন্ত্রাসের আবহ তৈরির চেষ্টা করছে। তবে এই হিংসার রাজনীতি বরদাস্ত করা হবে না।” তাঁর আরও অভিযোগ, বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাজ্যে সন্ত্রাস বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বিজেপি-সিপিএম একযোগে হামলা চালাচ্ছে। আমরা আইনের পথে ব্যবস্থা নেব।”

মুখ্যমন্ত্রী এ সব বলার আগেই অবশ্য কান্তিবাবুর নামে অভিযোগ দায়ের হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে একটি খুনের ঘটনায় একই ভাবে এফআইআরে নাম দেওয়া হয়েছিল সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর। সিপিএমের অভিযোগ, বিভিন্ন ঘটনায় নেতাদের নাম জড়িয়ে দিয়ে তাঁদের হয়রান করার কৌশল নিয়েই চলছে শাসক দল। কান্তিবাবুও এ দিন তাঁর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ উড়িয়ে মন্তব্য করেছেন, “বাড়িতেই আছি। আমাকে গ্রেফতার করুক!”

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “আমাদের সৌজন্যকে দুর্বলতা বলে ভুল ব্যাখ্যা করবেন না!” স্পষ্টতই তাঁর ইঙ্গিত ছিল, সপ্তাহখানেক আগে নবান্নে বিমান বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের দিকে। যার জের টেনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও অভিযোগ করেছেন, “নিজেদের কর্মী খুন হচ্ছে বলে বামেরা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে নাটক করছে। অন্য দিকে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীকে বয়কট করছে! বিজেপি এর সঙ্গে প্ররোচনা দিচ্ছে।”

তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ অস্বীকার করে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ পাল্টা বলেছেন, “সব ঘটনার পিছনেই সিন্ডিকেট নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই এই পরিণাম।” তাঁর বক্তব্য, বিজেপি খুনোখুনির রাজনীতির অবসান চায়। নিজেদের গোষ্ঠী-কোন্দলের জেরে হওয়া খুনকে তৃণমূল তাঁদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে বলে দাবি করেছেন বিজেপি-র জেলা সম্পাদক দেবতোষ আচার্যও।

রায়দিঘিতে কী ঘটেছিল শনিবার রাতে? প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের বক্তব্য, লোকসভা ভোটের পর থেকেই সরস্বতীপাড়া ও সংলগ্ন এলাকায় খালপাড়ের জমির দখল নিয়ে স্থানীয় হাফিজুল গাজি ও আনার মোল্লার গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ চলছিল। এঁরা সম্পর্কে শ্যালক-ভগ্নিপতি। পরে ওয়াজেদ কামারু ও স্থানীয় তৃণমূল নেতা ভগবান অধিকারীর অনুগামীরাও ওই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। শনিবার কাশীনগরে ভগবানের কাঠগোলায় এ নিয়ে সালিশি বৈঠকের ব্যবস্থা হয়। ওই বৈঠক থেকে ফেরার পথেই ফের এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর উপরে হামলা চালায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়, নিহত চার জন-সহ কয়েক জন শনিবার রাতে একটি অটোয় চেপে ফিরছিলেন। হঠাৎই পিছন থেকে আর একটি অটো এসে তাদের পথ আটকে দাঁড়ায়। শুরু হয় বোমাবাজি। ৩০-৩৫ জনের একটি দল আগের অটোর লোকজনকে ঘিরে ধরে। অটো থেকে তাঁদের নামিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। কয়েক জন ছুটে পালাতে গেলেও পারেননি। নিহতদের এক জন, হাসান ছুটে গিয়ে স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য সাহানারা বেগমের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। সেখানে ঢুকেই তাঁকে কুপিয়ে খুন করা হয়। সাহানারার বাড়িতে ঢুকে এ দিন দেখা যায় বাড়ির মেঝে, দেওয়াল, বিছানায় রক্তের দাগ। পড়ে আছে মাংসের টুকরো। সাহানারা বলেন, “শনিবার রাতে আমি ঘরে বসে দর্জির কাজ করছিলাম। হঠাৎই হাসান দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। তার পিছনে পিছনে হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক জন। ঘরে ঢুকেই ওরা হাসানকে কোপাতে থাকে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা বেরিয়ে যায়।” ঘরের মধ্যেই হাসানের রক্তাক্ত দেহ পড়েছিল। সাহানারা চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডাকেন। কিছু ক্ষণ পরে পুলিশ এসে দেহ নিয়ে যায়।

দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের নেতৃত্বে এ দিন তৃণমূলের এক প্রতিনিধিদল নিহতদের বাড়িতে যান। দলে ছিলেন পার্থবাবু, শোভন চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, চৌধুরী মোহন জাটুয়া প্রমুখ। নিহতদের পরিজনদের আশ্বাস দিয়ে মুকুলবাবু বলেন, “ঘটনায় জড়িতদের চরম শাস্তি দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই আমরা এখানে এসেছি।” নিহতদের বাড়ি ঘুরে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে ওই ঘটনায় জখম তিন তৃণমূল কর্মীকে দেখতেও যান তাঁরা। পরে মুকুলবাবু বলেন, “খুনের ঘটনার দু’ঘণ্টা আগে সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এই এলাকায় ঘুরে যান। এ বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। যত বড় নেতা হোন, কাউকে ছাড়া হবে না!” পার্থবাবুও বলেন, “এটা সিপিএমের এলাকা। এখানে ঢোকার সময় মহিলারা ফিস ফিস করে বলছিলেন, শনিবার কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় এলাকায় ঘুরে গিয়েছেন। আমরা সব দিকই বিবেচনা করে দেখছি।” খুনের প্রতিবাদে এ দিনই রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল করেছে তৃণমূল। আজ, সোমবার কালো ব্যাজ পরে রাজ্য জুড়ে তারা কালা দিবস পালন করবে। মঙ্গলবার সন্ত্রাস-বিরোধী দিবস পালন করা হবে।

মুকুল-পার্থবাবুদের অভিযোগের জবাবে কান্তিবাবু বলেছেন, “তৃণমূল নেতারা হয়তো জানেন না, রায়দিঘিতে আমার বাড়ি রয়েছে। সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন এখানে আসি এবং থাকি। ওই সব এলাকা দিয়েই আমাকে যাতায়াত করতে হয়।” নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই প্রকৃত ঘটনা বেরোবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ওই এলাকাটি সিপিএমের বলে পার্থবাবুর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, এ বার লোকসভা ভোটে স্থানীয় বুথে তৃণমূল ৫২৭টি ভোট পেয়েছে। সিপিএম পেয়েছে ১৭৪টি ভোট। এলাকায় কাদের আধিপত্য, এতেই বোঝা যায়!

shubhashis ghatak raydighi fir against kanti ganguly
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy