Advertisement
০৫ মে ২০২৪

কিষাণ মান্ডি কতটা কাজে লাগবে, ধন্দ

লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি চারটি কিষাণ মান্ডির উদ্বোধন হয়েছিল। চার মাস পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটিও কাজ শুরু করেনি। কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে খবর, এখনও বাজার পরিচালনার কমিটি কাজ শুরু করেনি। তাই নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েও চালু হয়নি মান্ডি। চাষিদের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না। মান্ডি তৈরির যুক্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

দিবাকর রায় ও শুভাশিস সৈয়দ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি চারটি কিষাণ মান্ডির উদ্বোধন হয়েছিল। চার মাস পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে, একটিও কাজ শুরু করেনি। কৃষি বিপণন দফতর সূত্রে খবর, এখনও বাজার পরিচালনার কমিটি কাজ শুরু করেনি। তাই নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েও চালু হয়নি মান্ডি। চাষিদের আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না। মান্ডি তৈরির যুক্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

ফড়েদের হাত এড়িয়ে চাষিরা যাতে সরাসরি ফসল বিক্রি করতে পারেন, তার জন্য প্রতি ব্লকে কিষাণ মান্ডি তৈরি করছে রাজ্য সরকার। তিন জেলায় চারটি কিষাণ মান্ডির আশেপাশে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, ওই বাজারগুলি নানা কারণে তাঁদের কাছে সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। এক, অধিকাংশ কৃষক বাজার তৈরি হয়েছে জনবিরল এলাকায়, যেখানে যাতায়াতের সুবিধে নেই। দুই, ব্যবসায়ী বা ফড়েরা এসে খেত থেকে ফসল নিয়ে যান। তাই ফসল নিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য সময়, অর্থ দিতে চাষিরা আগ্রহী নন। আর তিন, চালু হাট-বাজার ছেড়ে নতুন বাজারে যেতে নারাজ ক্রেতা-বিক্রেতা, দুই পক্ষই। চালু বাজারের উন্নতি না করে নতুন মান্ডি কেন, প্রশ্ন করছেন তাঁরা।

রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেই প্রতি ব্লকে সব্জি মান্ডি গড়ে তোলার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম পর্যায়ের ৯৫টি মান্ডির মধ্যে ২৫টি তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এ বছর পয়লা মার্চ যে চারটি মান্ডির উদ্বোধন হয়, তার দু’টি হুগলিতে। একটি সিঙ্গুরে তাপসী মালিকের নামে, অন্যটি ধনেখালিতে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এবং বীরভূমের সিউড়িতেও একটি করে কিষাণ মান্ডির উদ্বোধন হয়েছে। কিন্তু চালু হয়নি আজও। জেলা কৃষি বিপণন আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, কবে থেকে বাজার চালু করতে হবে সে বিষয়ে কোনও নির্দেশ আসেনি তাঁদের কাছে। কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, “প্রশাসনিক কর্তা এবং চাষিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাজার কমিটি তৈরি হয়েছে। বাজার খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”

কিন্তু কিষাণ মান্ডি খুললেও চাষিরা যাবেন কিনা, সেই প্রশ্ন ক্রমশ আরও বড় হয়ে উঠছে। বহরমপুর লাগোয়া ভাকুড়ি (দক্ষিণ) ‘মডেল ফার্ম’-এর মধ্যে প্রায় ১৫ বিঘা জুড়ে তৈরি হয়েছে কিষাণ মান্ডি। জায়গা পর্যাপ্ত, কিন্তু এলাকাটি জনবিরল। যাতায়াতের তেমন কোনও ব্যবস্থাই নেই। বরং তার আড়াই কিলোমিটার দূরে আখের মিল এলাকায় বিশাল এলাকা নিয়ে চালু সব্জি বাজার রয়েছে। চাষি-ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, আখের মিলে কৃষক বাজারের পরিকাঠামো তৈরি করে দিলে তাঁদের উপকার হত। লরি দাঁড় করানোর জায়গা এখনও তৈরি হয়নি। সব্জি বিক্রেতা মাধব হালদারের বিস্ময়, “কার পরামর্শে ওই এলাকায় কিষাণ মান্ডি তৈরি হল, কে জানে!”

সিউড়ির হাটজন বাজার এলাকায় কিষাণ মান্ডি প্রস্তুত। সিউড়ি ২ ব্লকের দমদমার চাষি পুরবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “পুরন্দরপুর থেকে সিউড়ির মান্ডি যেতে হাটজন বাজারে নেমে প্রায় ৫০০ মিটার রাস্তা যেতে হবে। ভ্যানের ব্যবস্থা না থাকলে ঝাঁকায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।”

ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা তথা কৃষি বিপণন পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান নরেন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “বাজার তৈরির জন্য যে সমস্ত জায়গা বাছা হয়েছে, সেখানে চাষি কেন, কেউই যাবেন না।” তাঁর বক্তব্য, রাজ্যে প্রায় আড়াই হাজার আলুর হাট এবং সব্জি বাজার আছে। সেগুলোকে উন্নত করাই দরকার ছিল।

ফড়েদের উপর নির্ভরতাও চাষিদের আগ্রহের অভাবের একটা কারণ। তারকেশ্বরের প্রান্তিক চাষি অভয় গুপ্ত বলেন, “নিজে ফসল নিয়ে বাজারে গেলে মাঠে কাজ করবে কে? তা ছাড়া নিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্যান-ম্যাটাডোরের খরচ আছে।” তাঁর বক্তব্য, কিষাণ মান্ডি থেকে পাড়ায় পাড়ায় গাড়ি এসে সব্জি কিনলে সুবিধে হয় চাষিদের।

হুগলির দুটি মান্ডির অবস্থান মন্দ নয়। সিঙ্গুরের আলুর মোড়ের কাছে মান্ডির পাশেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। এক দিকে কামারকুণ্ডু স্টেশন, অন্য দিকে সিঙ্গুর স্টেশন। ধনেখালির সিমলায় কিষাণ মান্ডির কাছে ধনেখালি হল্ট এবং শিবাইচন্ডী স্টেশন। তবু চাষিরা নতুন বাজার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

সিঙ্গুর স্টেশনের পাশে, বারুইপাড়ায় আর নান্দায় সব্জির তিনটি বড় বাজার রয়েছে। ঘনশ্যামপুরের বাসিন্দা হারাধন দাস, তিষা গ্রামের চাঁদু ঘোষ, সকলেরই কথা, মান্ডিতে গেলে বাড়তি সুবিধে কী, তাঁরা বুঝতে পারছেন না। রাজ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের সদস্য কমল দে-র বক্তব্য, “সরকার নতুন ব্যবস্থা চালু করলেও চাষিরা অভ্যস্ত জায়গা ছেড়ে নতুন বাজারে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারছেন না।”

তবে কৃষি বিপণন মন্ত্রী আশাবাদী। অরূপবাবুর বক্তব্য, “মান্ডিতে ব্যাঙ্ক, এটিএম থাকবে। ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এ সব বাড়তি সুবিধের খবর পেলেই উত্‌সাহিত হবেন চাষিরা।” কিন্তু কবে সেই সব ব্যবস্থা তৈরি হবে, কবে তার প্রচার হবে চাষিদের মধ্যে, কবে থেকেই বা চাষিরা বসবেন বাজারে, তার স্পষ্ট সময়সীমা দিচ্ছেন না তিনি। ফলে নির্মীয়মাণ কিষাণ মান্ডিগুলোর ভবিষ্যত্‌ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অরূপবাবুরই দফতরে।

(সহ প্রতিবেদন: দয়াল সেনগুপ্ত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE