Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

চলছে অবাধে লুঠ, সারদার কারখানায় ঢুকে দেখল ইডি

প্রথমে বোলপুর, এ বার বেলিয়াতোড়। সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের আশঙ্কা যে মোটেও মিথ্যা নয়, বুধবার বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে গিয়ে তা ফের চাক্ষুষ করলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) অফিসারেরা। দেখলেন, কারখানা বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে যন্ত্রাংশ ও মালপত্রের যেন হরির লুঠ পর্ব চলেছে! ঠিক যে ছবিটা তাঁরা মঙ্গলবার দেখেছিলেন, বোলপুরের কোপাইয়ে সারদার রিসর্টে তদন্তে।

ইডির অফিসারের হাত ধরে মিনতি সিমেন্ট কারখানার সুপারভাইজার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।  ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

ইডির অফিসারের হাত ধরে মিনতি সিমেন্ট কারখানার সুপারভাইজার অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেলিয়াতোড় শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১১
Share: Save:

প্রথমে বোলপুর, এ বার বেলিয়াতোড়।

সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের আশঙ্কা যে মোটেও মিথ্যা নয়, বুধবার বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে গিয়ে তা ফের চাক্ষুষ করলেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) অফিসারেরা। দেখলেন, কারখানা বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে যন্ত্রাংশ ও মালপত্রের যেন হরির লুঠ পর্ব চলেছে! ঠিক যে ছবিটা তাঁরা মঙ্গলবার দেখেছিলেন, বোলপুরের কোপাইয়ে সারদার রিসর্টে তদন্তে।

বেলিয়াতোড় থানার ধবনী গ্রামে লোকসানে চলা ওই সিমেন্ট কারখানা ২০০৯ সালে সারদাকে বিক্রি করেছিলেন রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তা নিয়ে সোমবারই মন্ত্রীকে নিজেদের দফতরে ডেকে পাটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ইডি। এ বার ইডি হানা দিল সেই কারখানাতেই। মঙ্গলবারই সিউড়ি আদালত চত্বরে সুদীপ্ত সেন প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, রাজ্যের ভিতরে- বাইরে সারদার স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাঁর আর্তি ছিল, “সম্পত্তিগুলো সব লুঠ হয়ে যাচ্ছে, ওগুলো বাঁচান!” সুদীপ্ত যে ভুল বলছেন না, তা এ দিন

ধবনীতে সারদার ‘ল্যান্ডমার্ক সিমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে ওই কারখানায় ঢুকে সম্যক টের পেয়েছেন ইডি-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মনোজ কুমার এবং এনফোর্সমেন্ট অফিসার এন কে মাসা।

বস্তুত, কারখানার হাল দেখে অবাক হয়ে যান ওই দুই অফিসার। এ দিন দুপুর প্রায় ১২টা নাগাদ তাঁরা ধবনীতে পৌঁছন। কারখানার মূল দরজায় তালা না দেখে চমকে ওঠেন। ভিতরে ঢুকে দেখেন কারখানা চত্বরে চরছে গরু, দোতলা অফিস ঘরগুলির দরজা, জানলা কিছুই নেই। এমনকী, দেওয়াল কেটে চুরি করা হয়েছে এসি মেশিনও। কারখানার পিছনের দিকের সীমানা প্রাচীরও প্রায় নিশ্চিহ্ন। কারখানার গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পড়ে রয়েছে হপার, ক্লিনারের মতো কিছু যন্ত্র এবং কয়েক বস্তা সিমেন্ট। বস্তাগুলির গায়ে লেখা ‘দুর্গাপুর সারদা সিমেন্ট’। ইডি-র আধিকারিকেরা অবশিষ্ট যন্ত্রপাতি এবং অফিস ঘরগুলির ছবি তোলেন।

এর পরেই তাঁরা ফোন করে ডাকেন ধবনীর বাসিন্দা অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে, যিনি শ্যামাপ্রসাদবাবুর আমল থেকেই এই কারখানার সুপারভাইজার পদে কাজ করেছেন। বস্তুত, যে ১৮ বিঘা জমির উপরে এই সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ১৫ বিঘার মালিকই গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। সেই পরিবারেরই অন্যতম সদস্য অশোকবাবু। বাকি জমি গ্রামের অন্য কয়েক জনের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। অশোকবাবু আসতেই কারখানায় চলতে থাকা লুঠতরাজ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। কারখানার মূল গেটে তালা রয়েছে, এই মর্মে তাঁদের কাছে খবর ছিল জানিয়ে সেই তালা কে বা কারা ভাঙল, তা-ও অশোকবাবুর কাছে জানতে চান। অশোকবাবু দাবি করেন, “২০১২ সালের শেষ দিকে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা কারখানার দিকে আর আসি না। কারা এই মালপত্র লুঠ করছে তার কিছুই জানি না।”

কারখানায় কত জন কর্মী ছিলেন, কোন সময় থেকে কারখানা বন্ধ হয়, শ্যামাপ্রসাদবাবুর আমলে কারখানার হাল কেমন ছিল, এ সব তথ্যও জানতে চাওয়া হয় অশোকবাবুর কাছে। পাশাপাশি ঠিক কতটা জমিতে এই কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। অশোকবাবু জানান, পাঁচ একরের একটু বেশি জমিতে গড়া হয়েছিল কারখানা। পরে তদন্তকারীরা অশোকবাবুকে নিজেদের গাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে ফের একপ্রস্ত জেরা করেন। গাড়ি থেকে নেমে দৃশ্যতই ঘাবড়ে যাওয়া অশোকবাবু কেঁদে ফেলেন। ইডি-র অফিসারের হাত ধরে বলতে থাকেন, “স্যার, আমি কিছু করিনি। কিছু জানিও না।” একটু পরেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেন।

সারদার এই সিমেন্ট কারখানা দ্রুত নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে ইডি-র তরফে। ধবনীতেই তদন্ত শেষ করেননি ইডি-র দুই অফিসার। কারখানা থেকে বেরিয়ে অশোকবাবুকে সঙ্গে নিয়েই তদন্তকারীরা যান বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলা সাব-রেজিস্ট্রারের দফতরে। সেখানে কারখানার দলিল খতিয়ে দেখেন তাঁরা। পরের গন্তব্য, গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস। বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, সারদার সিমেন্ট কারখানাটি বড়জোড়া ব্লকে হলেও সেখানে রেজিস্ট্রি অফিস না থাকায় গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের সাব-রেজিস্ট্রার দফতরেই জমি রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। শ্যামবাবু যে জমি গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কিনেছিলেন, তার তথ্য সংগ্রহ

করতেই তাই গঙ্গাজলঘাটি গিয়েছিলেন ইডি-র তদন্তকারীরা।

বিকেলে গঙ্গাজলঘাটি বাসস্ট্যান্ডে অশোকবাবুকে নামিয়ে চলে যায় ইডি-র দল। অশোকবাবু বাসে চেপে বাড়ি ফেরেন। পরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ওই কারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় ৫০ জন কাজ করতেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর থেকেই আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। বন্ধ হওয়ার আগে চার মাস আমরা বেতনও পাইনি।” তাঁর আর্জি, সরকার যে ভাবে সারদার একটি টিভি চ্যানেলকে অধিগ্রহণ করে চালাচ্ছে, সে ভাবে এই কারখানাও চালু করুক। আর ইডি-র জেরা প্রসঙ্গে অশোকবাবুর বক্তব্য, “আমি সামান্য কর্মী মাত্র। ভিতরকার ব্যাপার কিছুই জানতাম না। এ সব বড় বড় লোকেদের ব্যাপার! ইডি-র অফিসারদের সে কথাই বলেছি।”

তাঁর এক সময়কার মালিকানার সিমেন্ট কারখানায় ইডি-র হানা নিয়ে মন্ত্রী শ্যামবাবু বলেন, “এই সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র আমি আগেই ইডি-কে জমা দিয়েছি। যা জানানোর, তা-ও জানিয়েছি। ওদের তদন্ত, ওরা করবে!” আর কারখানায় লুঠপাট? মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত জবাব, “সারদাকে বেচে দেওয়ার পরে ওই কারখানা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rajdeep bandyopadhyay beliatore sardah ed
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE