Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রদেশকে নির্দেশ রাহুলের

জোট করব না, কিন্তু লড়তে হবে সকলকে

প্রদেশ নেতারা না-চাইলে জোট হবে না। কিন্তু তাঁদেরও ভোটে লড়তে হবে সাহস করে। ময়দান ছেড়ে পালালে চলবে না। আজ রাজ্য কংগ্রেসের ১০ নেতাকে বাড়িতে ডেকে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিলেন দলের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধী। প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এর আগেও একাধিক নির্বাচনে একেবারে শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হয়েছে।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৮:২৬
Share: Save:

প্রদেশ নেতারা না-চাইলে জোট হবে না। কিন্তু তাঁদেরও ভোটে লড়তে হবে সাহস করে। ময়দান ছেড়ে পালালে চলবে না। আজ রাজ্য কংগ্রেসের ১০ নেতাকে বাড়িতে ডেকে স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিলেন দলের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধী।

প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এর আগেও একাধিক নির্বাচনে একেবারে শেষ মুহূর্তে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হয়েছে। ফলে এ বারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের দিকে হাত বাড়ানো হবে কিনা, সেই প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি, জোটের বিরুদ্ধাচরণ করলেও আসন্ন লোকসভা ভোটে প্রার্থী হতে রাজি নন রাজ্যের অধিকাংশ প্রবীণ কংগ্রেস নেতাই। প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর অনুরোধের উত্তরে প্রদীপবাবু থেকে শুরু করে মানস ভুঁইয়া, আব্দুল মান্নান, সকলেই ভোটে লড়বেন না বলে জানিয়েছেন। ব্যতিক্রম সোমেন মিত্র।

এই অবস্থায় আজই প্রথম রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের তাঁর ১২, তুঘলক লেনের বাড়িতে বৈঠকে ডেকেছিলেন রাহুল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের ৬ লোকসভা সাংসদ, তিন প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য, মানস ভুঁইয়া ও সোমেন মিত্র এবং বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান।

বৈঠকে উপস্থিত এআইসিসি-র এক নেতা পরে জানান, আলোচনার শুরুতেই রাহুল জানতে চান, রাজ্য নেতারা কি তৃণমূলের সঙ্গে জোট চান? কারণ, তৃণমূল প্রকাশ্যে জোট না-করার কথা বললেও গোপনে তাদের পক্ষ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করে বার্তা দেওয়া হচ্ছে।

এই প্রশ্নের জবাবে সকলেই কার্যত সমস্বরে জানিয়ে দেন, তাঁরা তৃণমূলের সঙ্গে কোনও ভাবেই জোট চান না। প্রদেশ নেতারা যুক্তি দেন, কংগ্রেসের কাঁধে চেপে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তাতে কংগ্রেসের কোনও লাভ হয়নি। উল্টে জোট করার ফলে রাজ্য কংগ্রেস অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। এই যুক্তি শোনার পরেই রাহুল জোট হবে না বলে তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন বলে এক প্রদেশ নেতার দাবি। তাঁর বক্তব্য, রাহুল এ-ও বলেছেন যে, জোট করে তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সব চেয়ে ক্ষতি হয়েছে। অতএব আর জোট নয়।

জোট করার ব্যাপারে মূল আগ্রহ তৃণমূলের রাহুলের এমন দাবি অবশ্য পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের শাসক দলের নেতারা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “রাহুল বিভ্রান্ত করছেন। তৃণমূলের কোনও নেতা কংগ্রেসকে জোটবার্তা দেননি। উল্টে কংগ্রেসেরই শীর্ষ নেতাদের একাংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তলে তলে বার্তা পাঠাচ্ছিলেন। তবে তৃণমূলনেত্রী বারবারই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের প্রশ্ন নেই। কেন না, কংগ্রেসের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই।”

দু’পক্ষের এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট সম্ভাবনা আরও অনিশ্চিত হল বলেই মনে করা হচ্ছে। এবং জোট না-হলে রাজ্যে কংগ্রেসকে যে নিজের জোরে যথাসাধ্য লড়তে হবে, সেটাও আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাহুল। নেতাদের কাছে তিনি জানতে চান, তাঁরা কী ভাবে লড়াই করার কথা ভাবছেন। তার পর নিজেই বলেন, তিনি চান ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের বার্তা দিতে সব বর্ষীয়ান নেতা ভোটে লড়ুন। এতে নিচু স্তরের কর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। এ ব্যাপারে তিনি যে কোনও অজুহাত শুনবেন না, সেটাও আজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাহুল।

সূত্রের খবর, বৈঠকে অধীরবাবু বলেন, তিনিও সব প্রবীণ নেতাকে প্রার্থী করার পক্ষপাতী। কিন্তু অনেকেই নানা অসুবিধার কথা বলছেন। এ কথা শুনে রাহুল জনে জনে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। শুরুতেই মানসবাবু। তিনি বলেন, জেলা কংগ্রেস কমিটি ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে জগন্নাথ গোস্বামীকে প্রার্থী করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। জগন্নাথ তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থ। ফলে তাঁকে সরিয়ে তিনি (মানসবাবু) প্রার্থী হন কী করে? মানসবাবু এ-ও বলেন, তাঁর স্ত্রী গীতাকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দিয়েছেন অধীরবাবু। তাতে তাঁর আপত্তি নেই।

কিন্তু এই সওয়ালে চিঁড়ে ভেজেনি। এক নেতার কথায়, “রাহুল বলেন, আপনার দাঁড়ানো আর আপনার স্ত্রীর প্রার্থী হওয়া এক হল! আজ যদি আমি অমেঠী থেকে প্রার্থী না হই, অন্য কাউকে প্রার্থী করি, তা হলে কি এক হবে?”

এর পরে আব্দুল মান্নানের মতামত জানতে চান রাহুল। হুগলির এই বর্ষীয়ান নেতা জানান, সম্প্রতি এক দুর্ঘটনায় তাঁর পায়ে চোট লেগেছে। অন্য কিছু শারীরিক সমস্যাও রয়েছে। পায়ের ক্ষতও রাহুলকে দেখান তিনি। মান্নান একই সঙ্গে বলেন, ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে প্রার্থী করা হয়নি। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটেও তাঁর চাঁপদানি আসনটি জোটের স্বার্থে তৃণমূলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার ২০১২ সালের রাজ্যসভার ভোটে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে প্রার্থী করে শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলা হয়।

এই পরিস্থিতিতে তাঁর জায়গায় তরুণ নেতা অমিতাভ চক্রবর্তীকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দেন মান্নান। যা শুনে রাহুল জানিয়ে দেন, কাকে প্রার্থী করা হবে, তা দল ঠিক করবে।

বয়স হয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে ভোটে লড়তে চাননি প্রদীপবাবুও। তিনি নতুনদের প্রার্থী করার কথা বলেন। কিন্তু রাহুল কোনও যুক্তিই শুনতে চাননি।

সূত্রের খবর, বৈঠকে এআইসিসি-র তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ খানের বক্তব্য ছিল, কোনও এক জনকে রেহাই দিলে অসাম্য হবে।

বর্ষীয়ানদের প্রার্থী করতে হলে, সবাইকেই প্রার্থী হতে হবে। শুধু তাই নয়, কলকাতা উত্তরে সোমেন মিত্র যে নিজে থেকেই প্রার্থী হতে রাজি হয়েছেন, তার প্রশংসাও করেন শাকিল। সোমেনবাবু বৈঠকে বলেন, তিনি আজ পর্যন্ত কখনও ভোটে হারেননি। এ বার জিতবেন কিনা জানেন না। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে যাবেন না।

বৈঠক শেষে রাহুল স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দু’টি বিষয় ঠিক হয়ে গেল। এক জোট হচ্ছে না। এবং দুই, কাদের প্রার্থী করা হবে তা অধীরবাবু হাইকম্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করবেন। দলের সকলকে সেই সিদ্ধান্ত মানতে হবে। রাজ্য কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, রাহুলের এই মনোভাবের পরে শুধু মান্নান-প্রদীপবাবুরা নন, শঙ্কর সিংহ, অরুণাভ ঘোষের মতো রাজ্য নেতাদেরও প্রার্থী করা হতে পারে।

দলের বর্তমান এক সাংসদ রাহুলকে প্রশ্ন করেন, সব ‘সিটিং এমপি-কে’ নিজ নিজ আসনে প্রার্থী করা হচ্ছে তো! রাহুল জবাব দেন, কে সিটিং, কে স্ট্যান্ডিং তা তিনি জানেন না। যে আসনে যাঁর জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তাঁকেই প্রার্থী করা হবে।

তা হলে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াল? কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা সবাই প্রার্থী হচ্ছেন? মান্নানের জবাব, “আমার অসুবিধার কথা রাহুলকে জানিয়েছি। এর পরেও যদি প্রার্থী হতে বলেন, তা হলে নির্দেশ মানতে হবে। কারণ, আর যাই হোক, দলের প্রতি আমার আনুগত্যে কখনও ভাটা পড়েনি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE