Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

জঙ্গলমহলে কেন বিস্ফোরক যাচ্ছিল, উদ্বেগ

এত বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক কী কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। রঘুনাথপুরে শনিবার কয়েক হাজার ডিটোনেটর ও জিলেটিন স্ট্রিক ভর্তি গাড়ি আটক করার পর থেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু গাড়ির চালক ও তার সঙ্গী পাথর খাদানের এক কর্মী ছাড়া রবিবার পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

গাড়ি থেকে বিস্ফোরক ভর্তি বস্তা বের করা হচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র।

গাড়ি থেকে বিস্ফোরক ভর্তি বস্তা বের করা হচ্ছে।—নিজস্ব চিত্র।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪৪
Share: Save:

এত বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক কী কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। রঘুনাথপুরে শনিবার কয়েক হাজার ডিটোনেটর ও জিলেটিন স্ট্রিক ভর্তি গাড়ি আটক করার পর থেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু গাড়ির চালক ও তার সঙ্গী পাথর খাদানের এক কর্মী ছাড়া রবিবার পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ওই সব বিস্ফোরক হাত ঘুরে মাওবাদীদের নাগালে যাচ্ছে কি না তাও ভাবাচ্ছে পুলিশ কর্তাদের।

রাজ্যের মন্ত্রী তথা বলরামপুরের বিধায়ক শান্তিরাম মাহাতো ও জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো দু’জনেই বলেন, “পাথর খাদানে ব্যবহার করার জন্য যে বিশাল সংখ্যক জিলেটিন স্টিক, ডিটোনেটর জঙ্গলমহলে ঢুকছে সেগুলি পরবর্তী সময়ে অন্য ধরনের নাশকতার কাজে ব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।”

রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত বলেন, “বিস্ফোরক উদ্ধারের পরে বিশদেই তদন্ত শুরু হয়েছে। ধৃত শেখ সাহাবুল ও পরেশ মুদিকে জেরা করে আরও তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। এর বেশি কিছু বলা এই মুর্হূতে সম্ভব নয়।” প্রসঙ্গত এ দিন ধৃতদের রঘুনাথপুর আদালতে তোলা হয়েছিল। তাদের চারদিনের পুলিশ হেফাজত হয়েছে।

শনিবার সকালে রঘুনাথপুর থানার ডুমরাকুড়ি গ্রামের অদূরে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কে একটি গাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল ১,১০০টি ডিটোনেটর ও ২,৭৯৭টি জিলেটিন স্টিক। প্রথমে আটক করা হয় গাড়ির চালক শেখ সাহাবুল ও পাথর খাদানের কর্মী পরেশ মুদিকে। দু’জনেই বরাবাজারের বাসিন্দা। তারা জেরায় পুলিশের কাছে দাবি করেছিল, রঘুনাথপুর থানার রায়ডি গ্রামের শেখ মোহরামের কাছ থেকে বিস্ফোরকগুলি বরাবাজারের বাসিন্দা রাজেশ সিংহের গাড়িতে চাপিয়ে বরাবাজারে পাথর খাদানের মালিক চন্দন সিংহের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ জানিয়েছেস বিস্ফোরক ধরা পড়ার পর থেকেই চন্দন ও রাজেশ পলাতক। বাড়িতে পুলিশ শেখ মোহারামকে পায়নি।

মোহরামের সন্ধান না পাওয়ায় একদিকে যেমন বিস্ফোরকগুলি সে কোথা থেকে এনেছিল, সে বিষয়ে পুলিশ অন্ধকারে। তেমনই চন্দন-রাজেশের হদিস না পাওয়ায় পাথর খাদানেই নাকি সেখান থেকে অন্যত্র বিস্ফোরক পাঠানো হচ্ছিল কি না, তাও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। বস্তুত গত জুন মাসেই পাড়া থানার রুকনি গ্রামের কাছে এইভাবে বিস্ফোরক পাচারের সময়ে আদ্রার আরপিএফ একটি গাড়ি থেকে প্রায় ৬০০টি ডিটোনেটর ও প্রায় ৫০০টি জিলেটিন স্টিক উদ্ধার করেছিল। গ্রেফতার করা হয়েছিল সাঁওতালডিহি ও পাড়া থানার দু’জনকে। পরে তদন্ত শুরু করে পাড়া থানার পুলিশ শালতোড়া থানার এলাকার এক ব্যক্তিকে ধরে। তার কাছে এই ধরনের বিস্ফোরক কেনার লাইসেন্স থাকলেও অবৈধ ভাবে ওই ব্যক্তি ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে এই বিস্ফোরক ধৃতদের বিক্রি করেছিল বলে তদন্তে জেনেছিল পুলিশ।

আর এই প্রেক্ষতেই অভিযোগ উঠছে, আরপিএফের হাতে জিলেটিন স্টিক ও ডিটোনেটর উদ্ধারের পরেও পুলিশ সক্রিয় না হওয়াতেই বন্ধ করা যায়নি বিস্ফোরক পাচারের ঘটনা। বিজেপির জেলা সভপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “তিন মাসের মধ্যে দু’টি থানা এলাকায় প্রচুর বিস্ফোরক উদ্ধার হওয়ার ঘটনাতেই স্পষ্ট অবৈধভাবে বিস্ফোরক পাচারের ব্যবসা চলছে রঘুনাথপুর এলাকায়। অথচ এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধে পুলিশ কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি।”

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ইসিএলের বারুদঘর ও কিছু পাথর খাদানের ব্যবসায়ীদের (যাঁদের এই বিস্ফোরক কেনার বৈধ অনুমতি রয়েছে) কাছে জিলেটিন স্টিক ও ডিটোনেটর থাকে। ফলে তাঁদের কাছ থেকেই বিস্ফোরক অবৈধ ভাবে পাচারের সম্ভবানা বেশি। তাছাড়া ইসিএলের বারুদঘরের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এই ধরনের বিস্ফোরক বাইরে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বস্তুত পাড়া থানার ঘটনায় শালতোড়ার এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের পরেই পুলিশ জানতে পেরেছিল যে দামে সরকারের কাছে থেকে এই বিস্ফোরক কিনছেন ওই ব্যবসায়ী, তার চাইতে অনেক চড়া দামে অবৈধ ভাবে সেই বিস্ফোরক বিক্রি করেছিলেন তিনি। কিন্তু রঘুনাথপুরের বিস্ফোরকের পরিমাণ দেখে পুলিশের ধারণা দফায় দফায় শেখ মোহরাম ওই বিস্ফোরক জোগাড় করে বাড়িতে রাখতে পারে। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “রঘুনাথপুরের ঘটনার বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে শেখ মোহরামকে দ্রুত গ্রেফতার করা জরুরি।”

অবৈধ পাথার খাদানেও পাথর ফাটাতে চোরাই বিস্ফোরক জোগাড় করা হয়। আগেও এই ধরণের বিস্ফোরক পাওয়া গেলে তা পরিমাণে কম ছিল। কিন্তু এ বার বিস্ফোরকের পরিমাণ পুলিশ কর্তাদের ভাবাচ্ছে। তেমনই আরও একটি বিষয় পুলিশকে ভাবাচ্ছে। পাড়া ও রঘুনাথপুর দু’টি ক্ষেত্রেই জিলেটিন স্টিক ও ডিটোনেটর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জঙ্গলমহলের দু’টি থানা বরাবাজার ও আড়শায় এলাকায়। সম্প্রতি আড়শা, বলরামপুরে মাওবাদীদের নামাঙ্কিত কয়েকটি পোস্টার উদ্ধার হয়। ত-ণমূলের তরফেও প্রতিরোধের ডাক দেওয়া হয় বলরামপুর, বান্দোয়ান প্রভৃতি এলাকায়। জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে মাওবাদীরা, এমন মনে করছেন জেলার গোয়েন্দারাও।

কাজেই এই ধরনের বিস্ফোরক পাথর খাদানের মালিকদের কাছ থেকে মাওবাদীদের হাতে পৌঁছনোর সম্ভবনাও উড়িয়ে দিতে পারছেন না দুঁদে পুলিশ আধিকারিকরা। তবে জেলা পুলিশের এক আধিকারিক দাবি করেছেন, “পাড়া থানার ঘটনায় আড়শার যে ব্যক্তির নাম এসেছিল তাকে ধরার পর দেখা গিয়েছে ওই বিস্ফোরক পাথর খাদান ও গ্রামে কুয়ো খোঁড়ার জন্যই কিনতে চেয়েছিলেন তিনি। রঘুনাথপুরের ঘটনাতেও ধৃতদের জেরা করে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, সেখানেও পাথর খাদানের জন্যই বিস্ফোরক কেনা হয়েছিল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

raghunathpur subhraprakash mondal explosive
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE