Advertisement
E-Paper

তারকা এনে ভোট মেলে না, বুঝল বিজেপি

ভোটের ফলাফল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন বিজেপি প্রার্থী মানবেন্দ্র রায়। সাংবিদকরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ছেন পরাজয় নিয়ে। ঠিক তখন কয়েক হাত দূরে জড়ো-হওয়া তৃণমূল সমর্থকদের দিক থেকে উড়ে আসছে ব্যঙ্গোক্তি। সব উপেক্ষা করে শান্ত ভাবে মানবেন্দ্রবাবু বললেন, “রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা হয়তো আমরা মানুষের কাছে সে ভাবে পৌঁছে দিতে পারিনি।’’

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:৪৭
জয়ের আনন্দে। রানাঘাটে ভোট গণনা কেন্দ্রের বাইরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

জয়ের আনন্দে। রানাঘাটে ভোট গণনা কেন্দ্রের বাইরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

ভোটের ফলাফল পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। গণনা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এলেন বিজেপি প্রার্থী মানবেন্দ্র রায়। সাংবিদকরা একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ছেন পরাজয় নিয়ে।

ঠিক তখন কয়েক হাত দূরে জড়ো-হওয়া তৃণমূল সমর্থকদের দিক থেকে উড়ে আসছে ব্যঙ্গোক্তি। সব উপেক্ষা করে শান্ত ভাবে মানবেন্দ্রবাবু বললেন, “রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা হয়তো আমরা মানুষের কাছে সে ভাবে পৌঁছে দিতে পারিনি।’’

নিচু তলার বিজেপি কর্মীরা অবশ্য নিশ্চিত, বিজেপি-র পরাজয়ের বড় কারণ এটাই। তৃণমূলকে বিপাকে ফেলার অনেক সুযোগ ছিল, দল যেটা কাজে লাগাতে পারল না, বলছেন বিজেপি নিচুতলার কর্মীরা। কৃষ্ণগঞ্জ এলাকার এক ব্লকস্তরের কর্মী যেমন বলছেন, “একদিকে রাজ্য নেতৃত্বের আনাগোনা, অন্য দিকে স্টারদের ভিড়। এইসব সামলাতে সামলাতেই তো দিন ফুরিয়ে গেল। এলাকায় মানুষের কাছে গিয়ে যে কথা বলব, সেই সময়টাই তো পেলাম না।”

হাঁসখালির দক্ষিণপাড়া এলাকার এক বিজেপি কর্মী বলছেন, “রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তো ছিলই। স্থানীয় এমন অনেক বিষয়ও ছিল, যা মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারলে আরও ভাল ফল হতে পারত।” তারকাদের দেখতে ভিড় হয়। কিন্তু ভোট বাড়াতে হয় সংগঠন দিয়েই, দল তা বুঝল না বলে আক্ষেপ করলেন ওই কর্মী।

বিজেপির জেলা সভাপতি কল্যাণ নন্দীও স্বীকার করছেন, এই পরাজয় সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলোকে দেখিয়ে দিচ্ছে। “দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে পারলাম,” বললেন তিনি। জেলা নেতৃত্বের দাবি, গত আট মাসে তাঁদের সংগঠন আগের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছিল। তবে দলের সক্রিয়তা যে পর্যায়ে নিয়ে গেলে জয়ী হওয়া যেত, এই ক’দিনে তা হয়ে ওঠেনি।

তা সত্ত্বেও কল্যাণবাবুর দাবি, “এই ফলকে আমাদের নৈতিক জয় বলতে পারেন। কারণ এর আগে বিজেপি একক ভাবে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেনি। মানুষ কিন্তু একটা বার্তা দিয়ে দিল যে, এ বার তৃণমূলের সঙ্গে আমাদের লড়াই হবে।” এবার বিজেপির মিশন ২০১৬, বলেন তিনি।

কিন্তু ফুল টস বলেও যে ছক্কা হাঁকাতে পারে না, সে কি নতুন ক্রিজে ভাল রান করতে পারবে? এ বার বিজেপির সামনে সুযোগ কম ছিল না।

ক্যাচ মিস বিজেপির

কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে নাকাশিপাড়ার চৌমুহা গ্রামে কুকথা বলে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ তৃণমূলের তাপস পাল। জেলার তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও তাঁর উপর বিরূপ হন। মুখ্যমন্ত্রী তাপসের পাশে দাঁড়ানোয় সংসদেও সমালোচনার মুখে পড়ে শাসক দল। সেই থেকে কৃষ্ণনগরের সাংসদ কার্যত এলাকাছাড়া।

গত ২৩ নভেম্বর কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা এলাকার ঘুঘড়াগাছিতে জমি দখলকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হ’ন স্থানীয় বাসিন্দা অপর্ণা বাগ। গুলিবিদ্ধ হ’ন আরও তিন জন। সেই ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা-সহ অন্যান্য দুষ্কৃতীদের মদতদাতা হিসাবে জড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষচৌধুরীর নাম। রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ে শাসক দল।

উপনির্বাচনে তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সত্যজিৎ বিশ্বাসকে প্রার্থী করা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হয় দলের অন্দরে। মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বিধান পোদ্দারকে প্রার্থী না করায় উজ্জ্বল, বিধান-সহ দলের অনেকেই নির্বাচনের আগে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

তা সত্ত্বেও কী করে এমন ফল করল তৃণমূল?

বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতা ছাড়া, নিজেদের প্রার্থীর জন্যও জয় এসেছে, বলছে তৃণমূল। জেলা নেতৃত্বের দাবি, কৃষ্ণগঞ্জ এলাকায় দলীয় সংগঠনটা হাতের তালুর মতো চেনেন সত্যজিৎ বিশ্বাস। তিনি নিজেও বুথস্তর থেকে উঠে আসা কর্মী। সেই কারণেই তিনি ভাল করেই জানতেন নিচু স্তরের কর্মীদের কী ভাবে ভোটের কাজে ব্যবহার করতে হয়। তাই বিজেপির নেতাকর্মীরা যখন তারকাদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন তখন শাসক দলের কর্মীরা নীরবে কাজ করে গিয়েছেন তৃণমূলস্তরে।

বিধি বাম

প্রথম থেকেই আশঙ্কটা করেছিলেন কর্মীদের একাংশ। সেই আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে এ বার তৃতীয় স্থানে নেমে এল সিপিএম। মাত্র আট মাস আগে লোকসভায় প্রাপ্ত ভোট থেকে এক ধাক্কায় তাদের ভোট কমে গেল প্রায় ২৪ হাজার। এ বার কৃষ্ণগঞ্জ উপনির্বাচনের প্রথম থেকেই কট্টর সিপিএম কর্মীরাও জয়ের কথা ভাবতে পারছিলেন না। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও দলের জেলা নেতৃত্ব ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁরা লোকসভায় প্রাপ্ত ভোটটাই ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। বিজেপিমুখী ভোট ব্যাঙ্ক কী ভাবে আটকানো যায়, তা নিয়েই তাঁরা বেশি চিন্তিত ছিলেন। সে চেষ্টা সফল তো হলই না, বরং তাঁদের ভোট ব্যাঙ্কে ব্যাপক ধস নামিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল বিজেপি। কিন্তু কেন মাত্র আট মাসের মাথায় এত বড় ধস নামল সিপিএমে? নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে দলের সক্রিয় কর্মীদের কথায়, “সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের কর্মীরাও আর নেতৃত্বের উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে অনেক সক্রিয় কর্মীই এ বার তৃণমূলের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপির ছাতার তলায় আশ্রয় নিয়েছেন।” দলের জেলা কমিটির সম্পাদক সুমিত দে এই ফলের জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “দলের একটা অংশ মনে করেছে যে, তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিতে হবে। তাঁরা আমাদের উপরে ভরসা রাখতে পারেননি।”

সাংগঠনিক দুর্বলতা যে রয়েছে সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় এ বারের বুথ ভিত্তিক ভোটের ফল লক্ষ্য করলেই। প্রথম দিকে কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক এলাকার ভোট গণনার সময়ে অনেকটাই ভাল অবস্থায় ছিল সিপিএম। ব্লকের পঞ্চায়েত এলাকার ভোট গণনার সময়ে বিজেপিকে অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু গণনা যত হাঁসখালি ব্লকের দিকে গড়িয়েছে, ততই সিপিএমকে পিছনে ফেলে দিয়ে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে।

ভোটের ফল সম্ভবত আগে থেকেই কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন সিপিএম প্রার্থী অপূর্ব বিশ্বাসও। সে কারণে এ দিন তিনি গণনাকেন্দ্রেই আসেননি। দিনভর বাড়িতেই ছিলেন। টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে অপূর্ববাবুর প্রতিক্রিয়া, “ফল এতটা খারাপ হবে ভাবিনি। এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সাংগঠনিক দুর্বলতা তো ছিলই। আমরা সর্বত্র কর্মী নামাতে পারিনি।” সিপিএম প্রার্থীর মতোই ভোটগণনা কেন্দ্রে দেখা যায়নি কংগ্রেস প্রার্থী নিত্যগোপাল মণ্ডলকেও। এ দিন ফোনেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

হতাশের দলে

তাঁকে একটা ফ্যাক্টর বলে মনে করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হল না। টিকিট না পেয়ে দল ছেড়েছিলেন বনগাঁর সুব্রত ঠাকুর। তিনিও সেই দলেই নাম লিখিয়েছিলেন। কৃষ্ণগঞ্জের প্রয়াত তৃণমূল বিধায়ক সুশীল বিশ্বাসের কন্যা সুনয়না বিশ্বাস (ঘোষ) আনুষ্ঠানিক ভাবেই যোগ দিয়েছিলেন বিজেপি’তে।

সোমবার কৃষ্ণগঞ্জ উপনির্বাচনে বিজেপি-র ভরাডুবির পরে সেই সুনয়নাই জানিয়ে দিচ্ছেন, “প্রচারে ঘাটতি থেকে গিয়েছিল। না হলে ওই আসনে বিজেপি-র হারার কোনও কারণই নেই। মানবেন্দ্রবাবু ভাল প্রার্থী। আমি ওঁর পাশেই আছি।”

সুশীলবাবুর মৃত্যুতে উপনির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই ওই কেন্দ্রে শাসক দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তাঁর নামই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণার পরে দেখা যায়, শিকে ছিঁড়েছে নদিয়া জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের ঘনিষ্ঠ সত্যজিৎ বিশ্বাসের। পেশায় আইনজীবী সুনয়না জানান, প্রচারের ঘাটতিই তাঁদের এই উপনির্বাচনে পিছিয়ে দিয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যা, “কয়েকটি বাজার এলাকায় প্রচার করা হলেও বাড়ি-বাড়ি ঘুরে যে প্রচারটা তৃণমূল করেছে তা আমরা করতে পারিনি।” তিনি জানান, সময়াভাবেই নেতারা বাড়ি বাড়ি প্রচার করতে পারেননি। তাঁর বাবা যে ভাবে গ্রাম-বৈঠক করতেন, প্রচারের সে পদ্ধতিও নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন সুনয়না।

tmc bjp sushmit haldar krishnaganj by election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy