Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দীপক-রিয়াজকে ধরা দিতে চাপ দলের

ক’দিন আগেও দীপক সাউকে তৃণমূলের মিছিল-মিটিংয়ে পতাকা নিয়ে হাঁটতে দেখেছেন গোলাবাড়ির মানুষ। তৃণমূলের অনেক নেতাকেই ঘুরতে দেখেছেন রিয়াজ আহমেদের মোটরসাইকেলে চেপে। এমনকী, রিয়াজ-দীপকের বাড়িতেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই নেতাদের। কার্যত, তৃণমূলের ওই নেতাদের হাত ধরেই রাজনীতিতে আসা দুই যুবকের। গত ২০ জুন হাওড়ার এক হোটেল-ম্যানেজারকে মারধর ও হুমকির পরে মালিকের অপমৃত্যুতে তৃণমূলের নাম জড়িয়ে যায়। তার পরে এখন সেই নেতারাই রিয়াজ ও দীপককে আত্মসমর্পণের জন্য নিয়ত চাপ সৃষ্টি করছেন এমন অভিযোগ দুই পরিবারের।

হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরীর (সবুজ পাঞ্জাবি) সঙ্গে এক দলীয় মিছিলে রিয়াজ (সাদা শার্ট)।—ফাইল চিত্র।

হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরীর (সবুজ পাঞ্জাবি) সঙ্গে এক দলীয় মিছিলে রিয়াজ (সাদা শার্ট)।—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০২:৪৯
Share: Save:

ক’দিন আগেও দীপক সাউকে তৃণমূলের মিছিল-মিটিংয়ে পতাকা নিয়ে হাঁটতে দেখেছেন গোলাবাড়ির মানুষ। তৃণমূলের অনেক নেতাকেই ঘুরতে দেখেছেন রিয়াজ আহমেদের মোটরসাইকেলে চেপে। এমনকী, রিয়াজ-দীপকের বাড়িতেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই নেতাদের। কার্যত, তৃণমূলের ওই নেতাদের হাত ধরেই রাজনীতিতে আসা দুই যুবকের। গত ২০ জুন হাওড়ার এক হোটেল-ম্যানেজারকে মারধর ও হুমকির পরে মালিকের অপমৃত্যুতে তৃণমূলের নাম জড়িয়ে যায়। তার পরে এখন সেই নেতারাই রিয়াজ ও দীপককে আত্মসমর্পণের জন্য নিয়ত চাপ সৃষ্টি করছেন এমন অভিযোগ দুই পরিবারের।

গোলাবাড়ির পিলখানা ঘিঞ্জি এলাকায় পাঁচতলা এক ফ্ল্যাটবাড়ির তিন তলায় বাবা-মাকে নিয়ে থাকেন রিয়াজ। স্ত্রী থাকেন পটনায়, বাপের বাড়িতে। ওই ফ্ল্যাটে বসেই শনিবার রিয়াজের বাবা শেখ চাঁদ বলেন, “আমার ছেলে সমাজসেবা করত। পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে যুব তৃণমূলের সভাপতি থাকার সময়ে রিয়াজই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। মন্ত্রী অরূপ রায়, বিধায়ক অশোক ঘোষ, কাউন্সিলর গৌতম চৌধুরী কে না এসেছেন ওই সব অনুষ্ঠানে। এ ছাড়াও বাড়িতে নেতাদের যাওয়া-আসা লেগেই ছিল।” কিন্তু হোটেলে মারধর ও গোলমালের পরে সেই নেতারাই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। বিপদে সাহায্য করা তো দূরের কথা, উল্টে ছেলে যাতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে অভিযোগ রিয়াজের বাবার।

রিয়াজদের পারিবারিক ব্যবসা কলকাতার বিভিন্ন বাজারে চারা মাছ সরবরাহ। হাওড়া মাছ বাজারেই তাঁদের আড়ত। চাঁদ জানান, ব্যবসার কারণে মাঝে মধ্যেই রিয়াজকে ভিন রাজ্যে যেতে হতো। কিন্তু গত ২২ জুন ব্রিজ হোটেলের মালিক সুমিত নাহার মৃত্যুর পরের দিন থেকে সে বেপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ সে কথা মানতে চাইছে না বলে অভিযোগ রিয়াজের মা নুরজাহান বিবির। তিনি বলেন, “রাতবিরেতে পুলিশ আসছে। ভয় দেখাচ্ছে। ছেলেকে আত্মসমর্পণ করাতে বলছে। কিন্তু ও কোথায় আছে সেটাই তো আমরা জানি না!” পুলিশ অবশ্য রিয়াজের পরিবারের উপরে চাপ সৃষ্টির অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। হাওড়ার পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে বলেন, “রিয়াজের খোঁজে পুলিশ ওর বাড়িতে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু বাড়ির লোককে চাপ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”

পিলখানারই ৪১৮ নম্বর জি টি রোডের ঠিকানায় ছ’তলার ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকে দীপকের পরিবার। তাঁর স্ত্রী গীতাদেবী এ দিন দুপুরে বলেন, “আমার স্বামী প্রথম থেকেই তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। দলের মিটিং-মিছিলে যান। গত লোকসভা ভোটেও স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখন সেই নেতারাই লোক পাঠিয়ে দীপককে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য হুমকি দিচ্ছেন।” গীতাদেবীর অভিযোগ, পুলিশ এসে বলে গিয়েছে, সাত দিনের মধ্যে দীপক থানা বা আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে দেবে। কিন্তু দাদা কোথায় গিয়েছে, তা পরিবারের কেউ জানে না বলেই জানিয়েছেন দীপকের বোন প্রতিমা সাউ। তিনি বলেন, “২৩ জুন (হোটেল-মালিকের মৃত্যু হয় ২২ জুন) সকালে দাদা আমাকে ফোন করে বলে, কাজে বাইরে যাচ্ছি। তোর বউদির শরীর খারাপ। ওর দেখভাল করিস। তার পর আর দাদার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।”

দীপকের পরিবার জানিয়েছেন, এ দিন দুপুরেই তৃণমূল নেতা সন্তোষ সাহানি দলবল নিয়ে তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন। গীতাদেবী বলেন, “আমাকে ওঁরা চারটি মোবাইল নম্বর দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, দীপকের খোঁজ পেলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জানানো হয়।” গীতাদেবী জানান, তৃণমূলের ওই নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, অবিলম্বে দীপক আত্মসমর্পণ করুক, এটাই দলের ওপরতলার নির্দেশ। এ ব্যাপারে শনিবার রাতে সন্তোষের মোবাইলে ফোন করা হলে সেটি ধরেও কেউ কথা বলেনি। তবে তৃণমূলের শহর সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপবাবু বলেন, “আত্মসমপর্ণের জন্য কাউকে দলের তরফে চাপ দেওয়া হচ্ছে না। তবে পুলিশকে অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে।”

রিয়াজ-দীপকের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতার কথা দুই পরিবারের তরফে দাবি করা হলেও জেলা নেতৃত্ব ওই সংস্রবের কথা স্বীকার করতে চাননি। হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরী বলেছেন, “ওরা এক সময় তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী ছিল। কিন্তু ওদের নামে নানা অভিযোগ ওঠায় বছর দুয়েক আগেই দল সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল।” গৌতমবাবুর এই অভিযোগ অস্বীকার করে রিয়াজের বাবা শেখ চাঁদের বক্তব্য, “উনি মিথ্যে কথা বলছেন। বছর খানেক আগেই তৃণমূল এখানে রাখী বন্ধন উত্‌সব করেছিল। তখন গৌতমবাবুই রিয়াজের উপরে সব দায়িত্ব দিয়েছিলেন।” তৃণমূলের সঙ্গে রিয়াজ-দীপকের যে সম্পর্ক ছিল, এ কথা মানছেন উত্তর হাওড়ার তৃণমূল বিধায়ক অশোক ঘোষও। তাঁর বক্তব্য, “আমাদের দলে অনেক কর্মী। এদের কোনও দিনই আলাদা গুরুত্ব দিইনি।”

শুধু তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেই নয়, যে হোটেল-মালিকের অপমৃত্যুতে রিয়াজ-দীপকের নাম জড়িয়েছে, সেই পরিবারের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে দাবি শেখ চাঁদ, গীতাদেবী দু’জনেরই। চাঁদ জানান, ব্রিজ হোটেল লাগোয়া মাছ বাজারে দীপক ও রিয়াজের দোকান ছিল। দীর্ঘ দিন ব্যবসার কারণে নাহা পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেই সুবাদেই ওই হোটেলে নিয়মিত আড্ডা বসত। গীতাদেবী বলেন, “সুমিতদার মা মঞ্জুদেবীকে আমরা মাসিমা বলে ডাকতাম। উনি যখন হোটেলে আসতেন, আমিই ভালোমন্দ রান্না করে পাঠাতাম। উনিও আমার মেয়ের জন্য ক্যাডবেরি পাঠাতেন।”

ওই দুই পরিবারের দাবি অবশ্য মানতে চাননি মঞ্জুদেবী। তাঁর বক্তব্য, “ওঁদের কাউকেই চিনতাম না। তবে রিয়াজ ও দীপক নিয়মিত হোটেলে আসত। তখনই তাঁদের সঙ্গে পরিচয়।” মঞ্জুদেবীর পাল্টা অভিযোগ, “ওরা আমার ছেলেকে নানা ভাবে উত্যক্ত করত। হোটেলে এলে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখাত।’’ সুমিতবাবুর স্ত্রী মৌসুমীদেবীও রিয়াজদের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন “অন্যায় না করলে দীপক আর রিয়াজ লুকিয়ে আছে কেন?” মঞ্জুদেবী এ দিনও দাবি করেন, “তৃণমূল নেতৃত্বের মদতেই রিয়াজ ও দীপক লুকিয়ে আছে।”

অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই ওই ঘটনার সাত দিন পর, শনিবার দুপুরে সুমিতবাবুর বাগুইআটির বাড়িতে যায় গোলাবাড়ি থানার পুলিশ। তাঁরা মঞ্জুদেবী ও মৌসুমীদেবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সুমিতবাবুর পরিবারের ক্ষোভ, পুলিশ এত দিন পরে আসার সময় পেল। সুতরাং তদন্ত কেমন হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE