Advertisement
E-Paper

নবান্নে কি আত্মসমর্পণ, প্রশ্নে জেরবার বিমানের কড়া বার্তা

যাঁদের হাতে কর্মী-সমর্থকেরা মার খাচ্ছেন, তাঁদেরই নেত্রীর কাছে গিয়ে কি না ফিশফ্রাই খেয়ে এলেন বাম নেতৃত্ব! লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে এ তো আত্মসমর্পণ! নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিমান বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পরে এমনই বার্তা রটে গিয়েছে বাম শিবিরের ভিতরে-বাইরে! দলের অন্দরের আলোচনা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া উগরে দিচ্ছেন বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৪ ০৩:৩০

যাঁদের হাতে কর্মী-সমর্থকেরা মার খাচ্ছেন, তাঁদেরই নেত্রীর কাছে গিয়ে কি না ফিশফ্রাই খেয়ে এলেন বাম নেতৃত্ব! লোকসভা ভোটে পর্যুদস্ত হওয়ার পরে এ তো আত্মসমর্পণ! নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিমান বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পরে এমনই বার্তা রটে গিয়েছে বাম শিবিরের ভিতরে-বাইরে! দলের অন্দরের আলোচনা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া উগরে দিচ্ছেন বাম কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমানবাবুকে মঙ্গলবার কড়া ভাবে ঘোষণা করতে হল, মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসের জেরে তাঁরা কয়েক দিন অপেক্ষা করছেন। সন্ত্রাস বন্ধ না হলে নিজেদের পথ তাঁরাই বুঝে নেবেন!

সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী পক্ষের আদানপ্রদানই দস্তুর। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং বিশেষত, তৃণমূল-সিপিএমের সম্পর্ক যে হেতু সেই রসায়নের বাইরে, তাই এ বারের মোলাকাৎ নিয়ে বিতর্ক বেধেছে বিস্তর। বাম শিবিরের উপর থেকে নিচু তলায় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, এতে বোধহয় নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষতিই বেশি হল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশও মনে করছেন, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বামেদের দরবার না করতে গেলেও চলতো। রাজ্যপালের কাছে গিয়েই কাজ সারা যেত। কারণ, নিচু তলায় যে কর্মী-সমর্থকেরা প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছেন, তাঁরা ভেবে বসতে পারেন বাম নেতারা বোধহয় আত্মসমর্পণ করে ফেললেন! বিভিন্ন স্তরে কর্মী-সমর্থকদের প্রতিক্রিয়াও এমন ভাবনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

খুব স্বস্তিতে নেই তৃণমূলও। তীব্র বাম-বিরোধিতাকে পুঁজি করেই মমতা এত দিন তাঁর রাজনীতি করে এসেছেন। এখন বামেদের প্রতি তাঁর সদয় মনোভাব তৃণমূলের নিচু তলায় কিছুটা হলেও বিভ্রান্তি তৈরি করছে। এরই পাশাপাশি, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, বিরোধিতার পরিসর সব সময় থাকা প্রয়োজন। অতীতে সোমেন মিত্র, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের কংগ্রেসকে নরমে-গরমে সামলে দিয়েছিল শাসক সিপিএম। কিন্তু তাতে তারা রক্ষা পায়নি। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে সিপিএমকে ধরাশায়ী করে ছেড়েছেন মমতাই। এখন তিনিই যদি বামেদের পাশে ডেকে তাদের নিজস্ব পরিসর দখল করে নেওয়ার কথা ভাবেন, তা হলে বিজেপি-ই উল্টে আরও শক্তিশালী হবে! বাম-তৃণমূল রফা হচ্ছে মনে করে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী যাবতীয় জনসমর্থন বিজেপি-র দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে যেতে পারে।

নবান্নে বৈঠকের ১৫ ঘণ্টার মধ্যে আলিমুদ্দিনে এ দিন বামফ্রন্টের আলোচনায় মমতা-বিমান সাক্ষাতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়েই কাটাছেঁড়া হয়েছে। শরিক নেতাদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বামফ্রন্টে আলোচনা করেই ঠিক হয়েছিল বটে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে যে ভাবে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে, তাতে বামেদের সম্পর্কেই ভুল বার্তা যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঠিক হয়, আগামী ২৫ জুন (জরুরি অবস্থা ঘোষণার বর্ষপূর্তি) থেকে টানা কয়েক দিন কলকাতায় বাম নেতারা অবস্থান-বিক্ষোভে বসবেন। একই সঙ্গে সরকার এবং নিজেদের কর্মী মহলকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, আন্দোলনের সঙ্গে কোনও আপস তাঁরা করেননি। তবে মুখ্যমন্ত্রী যে হেতু অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন, তাই তাঁর ওই কথার প্রতি সম্মান জানাতেই আপাতত ওই কর্মসূচি প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হবে না। বৈঠকের পরে বিমানবাবু বলেন, “আমরা যাঁর কাছে গিয়েছিলাম, তিনি তো তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী নন! গোটা রাজ্যের এবং আমাদেরও মুখ্যমন্ত্রী! সম্ভাব্য সর্বত্র অভিযোগ জানিয়ে যখন কাজ হয়নি, তখনই তাঁর কাছে গিয়েছি।”

বিজেপি অবশ্য বাম এবং তৃণমূলকে প্রবল কটাক্ষ অব্যাহত রেখেছে। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন বলেছেন, “সন্ত্রাসের বাহানা নিয়ে সিপিএম নেতারা নিজেদের বাঁচাতে বৈঠক করলেন! বিজেপি-র হাত থেকে কী ভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেটাই ছিল এর উদ্দেশ্য।” বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় আবার মমতার দলকে ‘মার্ক্সবাদী তৃণমূল’ বলে কটাক্ষ করেছেন। আর রাহুলবাবুর মন্তব্য, “স্বীকৃত বিরোধী দলকে শাসক দল বলছে, আন্দোলন করুন! এটা কখনও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি।” এমনকী, সিপিএমের দুই বহিষ্কৃত নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা ও প্রসেনজিৎ বসুও বিবৃতি দিয়ে আত্মসমর্পণের অভিযোগই এনেছেন। বামফ্রন্টের কর্মী সমর্থকদের কাছে তাঁদের আবেদন, বামপন্থারধ্বংস রুখতে তাঁরা যেন নেতৃত্বের এই সুবিধাবাদ ও পরাজিত মনোভাবকে প্রত্যাখান করেন। বাম কর্মীদের কাছে প্রসেনজিৎদের আর্জি, “তাঁরা যেন যত শীঘ্র সম্ভব, প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করে এই নেতৃত্বকে অপসারণ করেন!” বাম শিবিরে ঈষৎ হাল্কা চালে এমন প্রশ্নও ঘোরাফেরা করছে, আসন্ন পুুরভোটে কি তবে বাম-তৃণমূল জোট হবে?

তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা অবশ্য বলেছেন, “এমন একটা হাওয়া তৈরি করা হচ্ছে, যেন বাম-তৃণমূল জোট হয়ে গেল! যেটা হয়ইনি, তা নিয়ে এত কথায় কী লাভ?” আর বিমানবাবুর যুক্তি, সাতের দশকে কংগ্রেসের সন্ত্রাস-রিগিংয়ের প্রতিবাদে বিধানসভা বয়কট করলেও অভিযোগ জানাতে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছেই গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী উদাহরণ দিয়েছেন, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯৬২ থেকে ’৬৬ পর্যন্ত নানা অত্যাচার হয়েছিল। তার পরেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁরা ইন্দিরা গাঁধীর প্রার্থী ভি ভি গিরিকে ভোট দিয়েছিলেন।

আবার ১৯৬৭ থেকে ’৭১-এর মধ্যে রাজ্যে দু’বার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। তার পরেও তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাঙ্ক, বিমা, খনি জাতীয়করণের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেওয়ায় তখন বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। পরে তা কেটে গিয়েছিল। এ বারও তেমন হবে বলে শ্যামলবাবুদের আশা। বিমানবাবু সেই সঙ্গেই আরও বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, এর আগে আমরা বিজেপি-র বিরুদ্ধে কোনও কথা বলছিলাম না!”

একেবারে কার্যক্ষেত্রে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের কিছুটা ফল পেয়েছেন বাম নেতারা। গড়বেতায় নিহত সিপিএম কর্মী সুইদুল ভুঁইয়ার দেহ পেতে হয়রান হচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী হালিমা বিবি। পুলিশ অভিযোগও নিতে চাইছিল না। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বিষয়টি জেনেই সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে কথা বলার পরে কাজ হয়েছে। সইদুলের দেহ সমাহিত করা হয় এ দিন বিকেলেই।

nabanno cpm left front tmc meeting
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy