Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
কিছু চেয়েছিল দিসনি নাকি

পাড়ুই শুনানির আগে অনুব্রতর পাশেই মমতা

মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে ওঁরা দু’জন। মঙ্গলকোটের নতুনহাট। বুধবার দুপুর। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই জনসভার মঞ্চে রয়েছেন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং ওই জেলারই লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। প্রথম জন খুন ও পুলিশকে বোমা মারতে উস্কানি দেওয়ায় অভিযুক্ত। অন্য জনের বিরুদ্ধে রয়েছে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ।

দলনেত্রীর সঙ্গে অনুব্রত। বুধবার মঙ্গলকোটের নতুনহাটে। সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

দলনেত্রীর সঙ্গে অনুব্রত। বুধবার মঙ্গলকোটের নতুনহাটে। সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে ওঁরা দু’জন।

মঙ্গলকোটের নতুনহাট। বুধবার দুপুর। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই জনসভার মঞ্চে রয়েছেন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং ওই জেলারই লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। প্রথম জন খুন ও পুলিশকে বোমা মারতে উস্কানি দেওয়ায় অভিযুক্ত। অন্য জনের বিরুদ্ধে রয়েছে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ। প্রথম জনকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি, তা নিয়ে ডিজি-কে রিপোর্ট দিতে বলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। অন্য জনের বিরুদ্ধে কেন চার বছর পরেও চার্জশিট দেওয়া গেল না, সেই প্রশ্ন তুলেছে একই আদালত।

বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থী অনুপম হাজরার সমর্থনে হওয়া এ দিনের জনসভার প্রথম থেকেই অনুব্রত যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। এবং আগের কয়েক বারের মতো এ দিনও নিজের ‘ঘনিষ্ঠ’ কেষ্টকে (অনুব্রত) আড়াল করে নানা মন্তব্য করেছেন তৃণমূল নেত্রী। অনুব্রতকে পাশে নিয়ে মমতা বলেন, “মাঝেমধ্যে এটাই বলি, কেষ্ট তোর কাছে কিছু চেয়েছিল, দিসনি নাকি? কেষ্টর কাছে কিছু চেয়েছিল, দিতে পারেনি। সারাক্ষণ কেষ্টর পিছনে দৌড়ে বেড়ায়। নিশ্চয় কিছু চেয়েছিল। বেচারা! চাইলে, মুড়ি-টুড়ি খাইয়ে দিতে পারিস! মুড়ি-নারকোল তো বাড়িতে আছে। এর জন্য ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।” তাঁর এই মন্তব্য কাদের উদ্দেশে, তা অবশ্য পরিষ্কার করেননি নেত্রী।

ঘটনাচক্রে আজ, বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে পাড়ুই মামলা (যে মামলায় প্রধান অভিযুক্ত অনুব্রত) নিয়ে শুনানির আগের দিনই মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। পাড়ুইয়ের পাশাপাশি লাভপুরের খুনের মামলাও বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে উঠবে। তার আগের দিন মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে অনুব্রতর উপস্থিত থাকার প্রসঙ্গ তাঁরা পাড়ুই-কাণ্ডের শুনানিতে তুলবেন বলে জানিয়েছেন ওই মামলার অন্যতম আবেদনকারী হৃদয় ঘোষ। একই ভাবে মনিরুলের মামলার ক্ষেত্রেও মমতার মঞ্চে তাঁর উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ।

বস্তুত, গভীর আগ্রহে এই মামলার ফলের দিকে তাকিয়ে থাকা হৃদয়বাবুর (গত বছর ২১ জুলাই পাড়ুইয়ে নিহত সাগর ঘোষের ছেলে) আশঙ্কা, “এতে অন্য দুষ্কৃতীরা উৎসাহিত হতে পারে। বিষয়টি আমার আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টের নজরে আনব।” তাঁর সংযোজন, “আগেও বলেছি, রাজ্য পুলিশ, সিআইডি এবং সিট নিরপেক্ষ তদন্ত করছে না। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও সেটাতে খানিকটা মদত দিচ্ছে!”

পাড়ুই মামলার আবেদনকারীর আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহরায় বলেন, “অনুব্রতর কাছে কারা কী চেয়েছিল, তা তিনি (অনুব্রত) বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) কাছে পরিষ্কার করে বলুন। তা হলে তদন্ত অনেক সহজ হয়ে যায়।” এত দিন সেটা তিনি বললেন না কেন, সেই প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী। তাঁর প্রশ্ন, “মামলাটি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে গিয়েছে তখন মূল অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে কেন?” কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যর অভিযোগ, “রাজ্যে গুন্ডারাজ কায়েম করতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি আগে বলেছিলেন, ‘আমি গুন্ডা নিয়ন্ত্রণ করি।’ অনুব্রত, মনিরুলকে পাশে নিয়ে আজ ফের সেই বার্তাটাই তিনি দিতে চাইছেন।”

এ দিন অনুব্রতকে নিয়ে মমতার বক্তব্য এবং মুখ্যমন্ত্রীর সভায় অভিযুক্ত ব্যক্তির উপস্থিতি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি সরকারি আইনজীবী (জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শুধু বলেন, “আদালত আমাকে বলেছে অনুব্রতর ওই সভা (গত বছরের ১৭ জুলাই)-য় কী কী ঘটেছিল এবং তার প্রেক্ষিতে রাজ্য কী ব্যবস্থা নেয় তা জানাতে। বৃহস্পতিবার আদালতকে আমি সেটাই জানাব।”

গত বছর ১৭ জুলাই পাড়ুই থানার কসবায় এক কর্মিসভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং তার পরেই সাগর ঘোষের খুনের ঘটনায় নাম জড়ায় বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রতর। তার পর থেকে একাধিকবার তাঁর পাশে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনার পরে ২৭ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেছিলেন, “অনুব্রতকে নিয়ে যারা রাজনীতি করছে, তাদের বলছি, ও তো চিঠি দিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা দিয়েছে। ও তো বলেছে এ কথা ও বলতে চায়নি। পুরনো একটা খবর নিয়ে মিডিয়া বারবার দেখাচ্ছে।”

এর পর চলতি ১৫ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুরে দলের যুব, যুবা ও ছাত্র কর্মশালায় মমতা বলেছিলেন, “কেষ্ট (অনুব্রত) এক জন ভাল সংগঠক। কেউ কেউ ওর পিছনে লাগে। এক জন ভাল সংগঠকের জন্য শেষ শক্তি দিয়ে থাকব।” এর দু’দিন পরেই বিধানসভায় একটি এফআইআর-এর প্রতিলিপি তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “নিহতের স্ত্রী-র দায়ের করা এটাই সেই প্রথম এফআইআর-এর কপি, যা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে দিনের পর দিন হইচই হচ্ছে। যে নাম নিয়ে এত কথা হচ্ছে, এফআইআর-এ কোথাও সেই নাম নেই!” পরে তিনি বলেন, “এই সভার সদস্য নয়, বলে নামটা বলছি না।”

লাভপুরের বিধায়ক মনিরুলকে নিয়ে অবশ্য এ দিনের জনসভায় কোনও মন্তব্য করেননি মমতা। তিন ভাইকে সালিশি সভায় ডেকে পিটিয়ে মারার ঘটনার মূল অভিযুক্ত তিনিই। হাইকোর্টে আক্রান্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ২০১০ সালের ৩ জুন জমি-বিবাদ সংক্রান্ত সালিশি সভায় স্থানীয় সিপিএম সমর্থক চার ভাইকে ডেকে আনা হয়েছিল। কথাবার্তা চলার মধ্যেই মনিরুলের নেতৃত্বে সশস্ত্র লোকজন চার ভাইকে পেটাতে শুরু করে বলে তাঁদের অভিযোগ। তিন জন মারা যান। চতুর্থ ভাই দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরে বেঁচে ফেরেন। পরিবারের এই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মনিরুলকে গ্রেফতার করলেও তিনি জামিন পেয়ে যান। সেই ঘটনার চার বছর পরেও পুলিশ কেন খুনের মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি, তা নিয়ে প্রশাসনের কৈফিয়ত তলব করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। রাজ্য সরকারকে তার জবাব দিতে হবে।

এক মঞ্চে মমতা-অনুব্রতর উপস্থিতি নিয়ে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শাস্তির বদলে গুরুত্ব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অসামাজিক কাজ করতে দলের লোককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উৎসাহী করছেন।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী আইন-আদালত, নির্বাচন কমিশন কোনও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকেই মানেন না। যিনি নিজের মুখের কথাকে আইন মনে করেন, তাঁর নিজেরই দলের নিহত কর্মীর পরিবারের অভিযোগকে ‘পিছনে লাগা’ বলে খাটো করতে পারেন, তাঁর কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে!

সিপিএমের মুখপত্রের কোষাধ্যক্ষ সুশীল রায়চৌধুরীর অপমৃত্যু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-নিয়ামক মণীষা মুখোপাধ্যায়ের অন্তর্ধান-রহস্য ইত্যাদি বিষয়ে অভিযুক্ত সিপিএম নেতাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন মুকুলবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anubarata parui mamata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE