Advertisement
E-Paper

ফের শ্রমিক অসন্তোষ চার চটকলে, কাজ বন্ধ দু’টিতে

ভদ্রেশ্বরের ‘নর্থব্রুক’-এর সিইও-হত্যার দু’দিন পরে ফের শ্রমিক অসন্তোষ আরও চার চটকলে। তার মধ্যে কাজ বন্ধ হয়ে গেল দু’টিতে। এক শ্রমিকের অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি এবং এক কর্তাকে মারধরের অভিযোগে মঙ্গলবার থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ভদ্রেশ্বরেরই ভিক্টোরিয়া চটকলের ‘ফিনিশিং’ বিভাগের দশ শ্রমিককে। প্রতিবাদে ওই বিভাগের বাকি শ্রমিকেরা এ দিন কাজে যোগ দেননি। এ দিনই জগদ্দলের অকল্যান্ড চটকল এবং হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ার হনুমান চটকলে ঝুলল ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর বিজ্ঞপ্তি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৪ ০৩:২৭

ভদ্রেশ্বরের ‘নর্থব্রুক’-এর সিইও-হত্যার দু’দিন পরে ফের শ্রমিক অসন্তোষ আরও চার চটকলে। তার মধ্যে কাজ বন্ধ হয়ে গেল দু’টিতে।

এক শ্রমিকের অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি এবং এক কর্তাকে মারধরের অভিযোগে মঙ্গলবার থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ভদ্রেশ্বরেরই ভিক্টোরিয়া চটকলের ‘ফিনিশিং’ বিভাগের দশ শ্রমিককে। প্রতিবাদে ওই বিভাগের বাকি শ্রমিকেরা এ দিন কাজে যোগ দেননি।

এ দিনই জগদ্দলের অকল্যান্ড চটকল এবং হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ার হনুমান চটকলে ঝুলল ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর বিজ্ঞপ্তি। বজবজের নিউ সেন্ট্রাল চটকলে উৎপাদন প্রায় বন্ধ। মঙ্গলবার মিলের বেতন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ফলে, শ্রমিকেরা বিক্ষোভ দেখান। বজবজে রাস্তা অবরোধ এবং ট্রেন অবরোধ করেন তাঁরা। আজ, বুধবার ওই চটকলের বেতন হওয়ার কথা।

সব মিলিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন চটকলের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। এ দিনই সার্বিক ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র বিভিন্ন চটকলের ৫২টি ইউনিটের প্রতিনিধিরা। শ্রমমন্ত্রী জানান, মিলে বিশৃঙ্খলা বা মারধর সরকার বরদাস্ত করবে না। তা কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। চটকলে নানা শিফ্টে শ্রমিকদের ঢোকা-বেরনোর সময়ে যাতে নজরদারি চালানো হয়, সে জন্য এসপি ও জেলাশাসকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

নর্থব্রুকের প্রসঙ্গ তুলে মন্ত্রী বলেন, “যখন রাজ্যে একটি সার্বিক পাট-নীতি তৈরি করা হচ্ছে এবং সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ভূমিকা নিয়ে রূপরেখা তৈরি হচ্ছে, তখন এ ধরনের ঘটনা মানা যায় না।” দলের শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের কাছে প্রতিটি চটকলের গেটে সভা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আবেদন জানান তিনি। পরামর্শ দেন, কোথাও কোনও অসুবিধা হলে পুলিশ-প্রশাসনকে জানাতে।

পরিবেশ-পরিস্থিতি যে ‘অস্বাভাবিক’ হতে চলেছে, তা নিয়ে এ দিন আশঙ্কা প্রকাশ করেন নিহত সিইও হরিকিষান মহেশ্বরীর শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়া হুগলির নানা চটকলের সিইও এবং পদস্থ কর্তারা। আজ, বুধবার তাঁরা হুগলির পুলিশ সুপারের কাছে নিরাপত্তা এবং চটকলের ভিতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার আর্জি নিয়ে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন রিষড়ার হেস্টিংস জুটমিলের সিইও শম্ভু সিংহ।

বস্তুত, ওই আশঙ্কারই ইঙ্গিত এ দিন মিলেছে ‘নর্থব্রুক’ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বের ভিক্টোরিয়া চটকলে। সোমবার রাতে ওই চটকলের ‘ফিনিশিং’ বিভাগের মৃত্যুঞ্জয় দাস অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিকদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। দু’পক্ষের বচসাও বাধে। সেই সময়ে ওই বিভাগের কিছু শ্রমিক অফিসে ঢুকে কাগজপত্র তছনছ শুরু করেন এবং বাধা দিতে গিয়ে জিএম-পার্সোনেল অরুণ কুমারকে চড়-থাপ্পড় মারা হয় বলে অভিযোগ তুলেছেন ওই চটকলের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রকুমার সিংহ। তাঁরা বিক্ষোভকারী দশ শ্রমিককে চিহ্নিত করে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন এবং তাঁদের কাজ থেকে আপাতত বসিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেন চটকলের গেটে।

বুধবার সকালে ওই বিজ্ঞপ্তি দেখে ওই বিভাগের সাড়ে ৩০০ শ্রমিক ক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবিলম্বে ওই দশ জনকে বহালের দাবি তোলেন। ‘ফিনিশিং’ বিভাগের শ্রমিক ওমপ্রকাশ চৌধুরীর অভিযোগ, “মিল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের শোষণ করছেন। সহকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিবাদ করি। সেটাই অপরাধ।” প্রায় একই অভিযোগ কাজ থেকে বসে যাওয়া রঞ্জিত নাথেরও। মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দু’জনেই। চটকল-প্রেসিডেন্টের দাবি, “মৃত্যুঞ্জয়বাবু গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাকি শ্রমিকদের কাজ করতে বলে তাঁকে আমরাই হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু আচমকা শ্রমিকেরা হামলা চালাল। নর্থব্রুকের ঘটনার পরে কড়া ব্যবস্থা নিতেই হতো। তাই দশ জনকে চিহ্নিত করে কিছু দিনের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার সমস্যাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস ঝোলানো হয় অকল্যান্ড চটকলে। ফলে, সমস্যায় পড়লেন সেখানকার সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক। এ দিন সকালে ওই নোটিস দেখে শ্রমিকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করা হয় সংলগ্ন ঘোষপাড়া রোড। স্থানীয় তৃণমূূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে। চটকলটি যাতে দ্রুত চালু করা যায়, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন বিধায়ক। চটকলটির মালিক জয় কাঙ্কারিয়া বলেন, “উৎপাদন চালু রাখায় ক্রমশ বস্তা জমছে। এখন যে অবস্থা, তাতে বরাত না মিললে মিল চালানো দুষ্কর। তবু, শ্রমিক-স্বার্থের কথা মাথায় রেখে কী করা যায় দেখছি।”

গরমের মধ্যেও টানা ১১ ঘণ্টা কাজ করার জন্য তাঁদের কর্তৃপক্ষ চাপ দিচ্ছেন, এই অভিযোগ তুলে হাওড়ার মালিপাঁচঘড়ার হনুমান চটকলের শ্রমিকেরা প্রথমে চটকলের গেটের সামনে বিক্ষোভ দেখান। পরে থানা ঘেরাও করেন। কোনও শ্রমিক কাজে যোগ না দেওয়ায় পরে ওই চটকলে কাজ বন্ধের বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো হয়।

শ্রমিকরা জানান, কয়েক মাস বন্ধ থাকার পরে গত এপ্রিলের শেষ দিকে মিলটি খোলার সময়ে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে মালিক পক্ষের একটি চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয়, এক মাস আট ঘণ্টার পরিবর্তে সকালে ১১ ঘণ্টা এবং রাতে ৯ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। এ জন্য অবশ্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুরনো সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁদের বেশি কাজ করানো হচ্ছে। এ জন্যই এ দিন তাঁদের বিক্ষোভ এবং থানায় স্মারকলিপি।

চটকলের তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক নাসিম খান অবশ্য বলেন, “বিরোধী শ্রমিক সংগঠনের কয়েক জনের সঙ্গে বাইরের লোকেরা মিলে এই বিক্ষোভ করেছেন। এটা কারখানাকে অচল করে বন্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত। বেশি সময়ের কাজের জন্য তো কর্তৃপক্ষ মজুরি দিচ্ছেন।” বিরোধী সংগঠনগুলি অভিযোগ মানেনি। চটকল কর্তৃপক্ষের দাবি, কিছু শ্রমিক বেশি সময় কাজ না করেই অতিরিক্ত মজুরি পেতে চাইছেন। তাই তাঁরা অহেতুক ঝামেলা করছেন।

বজবজের চটকলটির ৪১ শতাংশ মালিকানা রয়েছে রাজ্য সরকারের হাতে। সেখানকার তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের অনুমোদিত সংগঠনের সভাপতি শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য মিলের শ্রমিক অসন্তোষের দায় চাপান সিটু এবং এআইইউটিইউসি-র ঘাড়ে। শোভনবাবু বলেন, “সিটু এবং এআইইউটিইউসির সমর্থকেরা দিন দশেক আগে মিলের অফিসারদের মারধোর করে। এ ছাড়া তারা শ্রমিকদের মিলে ঢুকতেও বাধা দিচ্ছিল। এর ফলে উৎপাদন প্রায় বন্ধ। দিনে ৫০ টন থেকে নেমে উৎপাদন ১০ টনে ঠেকেছে।” অফিসারদের মারধরের অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন এআইইউটিইউসির সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর সাহা। তিনি বলেন, “কর্তৃপক্ষ মিলের মেশিন অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। শ্রমিকরা বাধা দেয়।”

চাপান-উতোর চলছেই। তার মধ্যেই চটশিল্পে কালো মেঘ ক্রমশ ঘন হচ্ছে।

hanuman jute mill auckland jute mill workers agitation jute mill
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy