কাঁকুড়গাছির রাস্তায় হাঁটার সময়েই দৌড়ে এসে মালা পরিয়ে দিলেন কয়েক জন সদ্য যুবা। সঙ্গে সদর্প ঘোষণা: ‘এ বার কিন্তু বস্ বামফন্ট জিতছে।’ পাশ থেকে আর এক জনের গলা, ‘গুর্রু, বামফন্ট জিতবেই।’
কলকাতা উত্তরের সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচীর সমর্থনে পা মিলিয়েছিলাম দলীয় পদযাত্রায়। সেখানেই এই অভিজ্ঞতা। হেসে বললাম, ‘আরে, আমি তো প্রার্থী নই, আমাকে মালা পরানো কেন?’ উত্তর আসে, ‘গুর্রু, আপনাকেই তো দিলাম! বামফন্ট ফিরছে কিন্তু।’
চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, খেটে খাওয়া মানুষ এঁরা। আর তখনই মনে হল, এই ভাষাতেই তো জনসভায় কথা বলেন মিঠুন আর দেব। একেবারে সাধারণ মানুষের ভাষায়। ওই যে মিঠুন বলেন, ‘বোতাম টিপব এখানে সরকার গড়ব দিল্লিতে।’ অনেকটা ওই ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ গোছের। সে ভাষা সাধারণ মানুষ পছন্দও করেন।
কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাল করতে গেলে, তাদের দেখাশোনা করতে গেলে তো শুধু ওই ধরনের কথা বললেই হয় না, পলিটিক্যাল সায়েন্স জানা কিছু লোকেরও দরকার হয়। এই ফাঁকে বলে রাখি, আমি অবশ্য সেই দরের লোক নই। এই কারণেই আমি রাজনীতিতে নামি না, প্রার্থী হতে চাই না, বক্তৃতাও দিই না। রাজনৈতিক নেতা নই আমি, কিন্তু পন্থায় বিশ্বাস করি। তার মধ্যে সব থেকে বড় হল মনুষ্যপন্থা। আর তার পরেই হল বামপন্থা। আমি বামপন্থায় বিশ্বাস করি।
আসলে কম বয়স থেকেই আমি বামপন্থী। কারণ, বাবা-কাকা-পিসে-মামা সকলেই এই ধরনের বামপন্থী কাজকর্মে জড়িত ছিলেন। এই কাজের জন্য তাঁরা বাহবা পেয়েছেন, পিঠ চাপড়ানিও পেয়েছেন, এক কথায় সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। ঠিক একই ভাবে আমার মা-মাসি-পিসি-কাকিমারাও বামপন্থী। তাঁরা মানুষের কাজই করে গিয়েছেন।
আমার বাবার বন্ধু ছিলেন মহেশতলার সিপিএম বিধায়ক আবুল বাশার। তিনি বাসে চেপেই বিধানসভায় যেতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার জন্য গাড়ি আছে। গাড়ি ব্যবহার করুন।’’ কিন্তু বাশার বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাঁরা কী ভাববেন? আমি যে গাড়িতে যাচ্ছি, সেটা তো খারাপ দেখাবে!’’ এই সব লোক দেখেই তো বড় হয়েছি!
এর আগে ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারেও ছিলাম। ২০১৩-য় হাওড়ায় লোকসভার উপনির্বাচনেও বাম প্রার্থীর হয়ে প্রচারে সামিল হয়েছি। কিন্তু গত দু’বারের তুলনায় এ বারে একটা তফাৎ দেখছি। গত দু’বারের তুলনায় এ বারে মানুষের সাড়া অনেক বেশি। সিপিএমের কর্মী-সমথর্কেরাও খুবই আশাবাদী দেখছি। যদিও একটা সার্জারির জন্য ডাক্তারের নিষেধে এ বার খুব বেশি চলাফেরা করছি না। তবে হাওড়ায় শ্রীদীপ ভট্টাচার্য এবং কলকাতা উত্তরে রূপা বাগচীর হয়ে প্রচার করেছি। হাওড়াতেও লোকেরা ছুটে এসে মালা পরিয়ে দিয়েছেন, হাতও মিলিয়েছেন।
সে সব দেখে মনে অন্য প্রশ্নও জাগছে কিন্তু। এটা কি ফেলুদাকে মালা দেওয়া না বামপন্থাকে মালা দেওয়া? এই আবেগ ভোটে পরিণত হলে তো ভালই হবে, না হলে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় জিতবেন।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু অন্য ধরনের বামপন্থায় বিশ্বাসী। তিনিও গরিব মানুষের কথাই বলেন। কিন্তু তিনি যে পার্টিটা করেন, তা সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি-র মতো ভাবধারার নয়। ব্যক্তি মমতা অনেক কাজও করেছেন, তাঁর কাজ করার ইচ্ছেও আছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যেমন, আমাদের টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও তো বামফ্রন্ট সরকার বিক্রিই করে দিচ্ছিল। আমরা সে সময় প্রতিবাদ করেছিলাম। অথচ মমতা সরকারি অর্থেই ওই স্টুডিও দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এটা তো ভাল কাজ, এটা বলতেই হবে। কিন্তু তিনিই আবার এমন অনেক কাজ করেছেন, যা না করলেও চলত। যেমন, ত্রিফলা আলো না লাগালেও চলত। এতে বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হত। এ রকম আরও অনেক বাজে খরচ কমানো যেত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহারও অত্যন্ত ভাল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মিশে দেখেছি। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের ভাল লাগাটাই শেষ কথা নয়।
আমার বিশ্বাস, এই সরকার থাকলে কিন্তু দরিদ্র মানুষের সমস্যা মিটবে না। কংগ্রেস বা বিজেপি-ও সে সমস্যা মেটাতে পারবে না। হয়তো বামফ্রন্ট সরকারই পারবে। অন্তত এই পশ্চিমবঙ্গে। দেশের কোন প্রান্তে কী দরকার, সে কথা বলতে পারব না। অতটা বুদ্ধি আমার নেই। কিন্তু এটা বুঝি, গত ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট যা করেছে তাতে কিছুটা হলেও গরিব মানুষের উপকার হয়েছে। উন্নতি হয়েছে গ্রামগঞ্জের।
এ বার অন্য একটা অনুভূতিও হচ্ছে। এখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় নেই। এখন কিন্তু লোকে ভয় পাচ্ছে। একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে কি মানুষ শাসক দলকে ভয় পাচ্ছে? শাসক দল কি ভয়ের সঞ্চার করছে? এই যে মহিলারা এখন ঘন ঘন বলছেন, ‘আমরা রাত্রে রাস্তায় বেরোতে ভয় পাই।’ এটা কি মিডিয়ার উস্কানি? এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হল? এ রকম তো হওয়ার কথা ছিল না!
দিনের শেষে মানুষের কথা বলে বামপন্থাই। বলে ওই মানুষগুলোর কথা, যারা ছুটে এসে মালা পরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এ বার কিন্তু বস্ বামফন্টই আসছে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy