আগে যা হয়েছে, এ বারও তাই হল! যুগ যুগ ধরে কারবার করে আসা আলু ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের একাংশের দাবি চাহিদা-জোগানের স্বাভাবিক নিয়ম অগ্রাহ্য করে বাজারকে জবরদস্তি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষেরই দুর্ভোগ বাড়াল রাজ্য সরকার।
নবান্নে বার বার বৈঠক, ব্যবসায়ীদের নানা হুঁশিয়ারি, ভিন্রাজ্যে যাওয়ার পথে আলুবোঝাই লরি ধরপাকড়, মিলনমেলায় আলুর গুদাম বানানো প্রায় এক মাস ধরে নানা অস্ত্র প্রয়োগ করার নিট ফল কিন্তু বাজারে জ্যোতি আলুর দাম সেই কেজি প্রতি ২২-২৩ টাকা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় দর বেঁধে দিয়েছেন ১৪ টাকা। কার্যত তার পরেই আলুর দর আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে এবং নামার কোনও লক্ষণই নেই। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরেই জ্যোতি আলুর দর এই ২২-২৩ টাকাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কিছু জায়গায় ১৪ টাকা কেজি আলু বিক্রির ব্যবস্থা যে হয়নি তা নয়। তবে তার গুণমান এমনই যে, সাধারণ ক্রেতা তার থেকে মুখ ফিরিয়েছেন।
আলু ব্যবসায়ী সংগঠনের একাংশের বক্তব্য, এ বছর আলুর ফলন ভাল হয়েছে। চাহিদা আর জোগানে ফারাক হওয়ার কথা নয়। সরকারের জবরদস্তিতেই বরং সাধারণ ক্রেতার ভোগান্তি বেড়েছে। কেবল তা-ই নয়, ধরপাকড়ের জেরে কয়েক হাজার কুইন্টাল আলু স্রেফ পচে নষ্ট হয়েছে। বাজারে এরও একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, দাম নিয়ন্ত্রণের নামে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ হলে অন্য রাজ্যে সরবরাহ এবং দাম দুটোই আয়ত্তের মধ্যে থাকবে।
বাজারের সাধারণ গতি নিয়ন্ত্রণে সরকার জোর খাটালে যে হিতে বিপরীতই হয়, গত বছরই তা টের পেয়েছিল রাজ্য। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নিয়ে না নিয়ে এ বারও একই পথে হেঁটেছে তারা।
বামফ্রন্ট সরকারও ২০১০ সালে এক বার আলুর মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলায় নেমেছিল। তবে সে বার সরকারই টাকা দিয়ে ব্যবসায়ীদের থেকে আলু কিনে রেশন দোকানে নির্দিষ্ট দামে বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। যদিও সে বারও সরকারের সেই উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কমই ছিল।
বর্তমান রাজ্য সরকার যে ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চেয়েছে, তাতে রাজ্য প্রশাসনের একাংশই বিস্মিত। তাঁদের মতে, বাজারে আলুর দাম কমানোই যদি সরকারের লক্ষ্য হয়, তবে মজুতদারির ব্যাপারে নজর দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে রাস্তা থেকে ব্যবসায়ীদের আলুবোঝাই লরি হুকুম-দখল করা হল। বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার এই কাজ করায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা যে দামে আলু কিনেছেন, সরকার তার চেয়ে কম দামে তা বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। আবার সরকারের আটক করা আলুর একটা বড় অংশ শেষ পর্যন্ত পচে নষ্ট হয়েছে।
মিলনমেলায় যে আলু মজুত রয়েছে, বিক্রেতারা তা কিনতে চাইছেন না। কারণ, বাজারে ১৪ টাকা কেজি দরে সরকারি আলু কিনে ক্রেতারা দেখছেন, অনেকটাই পচা। ফলে হরেদরে দাম বেশিই পড়ছে। সরকারের গড়া টাস্ক ফোর্সেরই এক সদস্য শনিবার জানান, শুক্রবার তবু কিছু ব্যবসায়ী মিলনমেলা থেকে আলু কিনে বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন প্রায় কোনও ক্রেতা নেই। এ দিন বিকেল পর্যন্ত মিলনমেলা থেকে একটি আলুর ট্রাকও বাজারমুখী হয়নি। ওই টাস্ক ফোর্সের সদস্য কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, সরকারি আলু আর বিক্রিযোগ্য অবস্থায় নেই। তিনি বলেন, “ন’টাকা দামে সরকারি আলু বিক্রির ব্যবস্থা করেছিলাম। তাতেও খদ্দের নেই। তার পরে ঠিক হল, ব্যবসায়ীদের আলু বেছে নিতে দেওয়া হবে। দাম নেওয়া হবে ১৩ টাকা কেজি। কিন্তু তবুও সরকারি আলু নেওয়ায় ব্যবসায়ীদের উৎসাহ নেই।” মানিকতলা বাজারের এক ক্রেতা বলেন, “সরকারি আলু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখি প্রায় সবই তার পচা। বাধ্য হয়ে ২৩ টাকা দামের আলু খাচ্ছি।”
কোলে বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা এ দিন জানান, ৫০ কেজি আলুর বস্তা ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায় এসে পৌঁছেছে। এক পাল্লা (৫ কেজি) বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। পোস্তা বাজারে আলুর এক পাইকারি বিক্রেতা জানান, গত কয়েক দিনে আলুর বস্তা-পিছু দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা।
বাজারে সব্জির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছরই টাস্ক ফোর্স তৈরি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মাঝে-মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও বাজারে হাজির হয়েছেন। তাতে সাধারণ ক্রেতাদের অন্তত কোনও লাভ হয়নি। এ বারও পুরসভার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ব্যবসায়ী যে দামেই আলু কিনে থাকুন না কেন, বাজারে তাঁকে ১৪ টাকা দরেই বিক্রি করতে হবে। এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি)-এর অফিসারেরা বাজারে ঘুরবেন। ১৪ টাকার বেশি দরে আলু বিক্রি করলেই ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।
ঘোষণাই সার, বাজারে ইবি-র অফিসারদের দেখা মিলছে না। তাঁদেরই কেউ কেউ বলছেন, এই পথে সমস্যার সুরাহা হবে না। উল্টে অশান্তি হবে। চলতি সপ্তাহের গোড়ায় কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু আশ্বাস দিয়েছিলেন, দু’তিন দিনের মধ্যেই আলুর দাম কমবে। তার জায়গায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে, আলুর দাম ছিটেফোঁটা কমারও লক্ষণ নেই। শুক্রবার পূর্ণেন্দুবাবু আর দাম কমানোর আশ্বাস দেননি। জানিয়েছেন, কাল, সোমবার নবান্নে টাস্ক ফের্সের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হবে। টাস্ক ফোর্সের এক সদস্য শনিবার জানান, সোমবারের ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীরও উপস্থিত থাকার কথা।
ব্যবসায়ীদের একাংশের বক্তব্য, জোর খাটিয়ে যে বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম বদলে দেওয়া যায় না, সরকার সেই শিক্ষা নিলেই পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারে। নবান্নের বৈঠকে যদি এই উপলব্ধি না আসে, তবে বাজারে সাধারণ ক্রেতার ভোগান্তি এড়ানো মুশকিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy