অরিন্দম চক্রবর্তী
বউভাতের দুপুরে স্বামীরা ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেন। আপনার-আমার মতো আমজনতাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভাতকাপড়ের জোগাড় করতে হয়। আর, রাজনীতিবিদরা ভাতকাপড়ের অধিকার নিয়ে আমাদের সচেতন করে দেন। এত সবের মধ্যে ভাতকাপড়ের ভাবনাকে দার্শনিকতার স্তরে তুলে এনে সকলকে চমকে দিলেন হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী। তাঁর ‘ভাতকাপড়ের ভাবনা এবং কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস’ ১৪২০ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।
কিন্তু দর্শন মানে তো কখনও ভাষা ও ধারণার বিশ্লেষণ, কখনও বা অস্তিত্ব, চেতনা, জ্ঞান ইত্যাদির কার্যকারণ সম্পর্কের অনুসন্ধান। রোজকার ভাতকাপড়কে কি আদৌ তুলে আনা যায় সেই ভাবনার স্তরে? প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বাংলা ভাষায় সেই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছিলেন। তাঁর বই মনে পড়িয়ে দিতে পারে ছান্দোগ্য উপনিষদের শুরুতে উষস্তি চাক্রায়ণের কাহিনি। শিলাবৃষ্টিতে শস্য বিনষ্ট, চাক্রায়ণ স্ত্রীর হাত ধরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্নমিতি হোবাচ সর্বাণি...। মানে, ‘অন্নই দেবতা। চরাচরের সমস্ত জীব অন্ন আহরণ করেই বেঁচে থাকে।’ অন্ন নিয়ে উপনিষদে যে কত গল্প! ঋষি আরুণির পুত্র শ্বেতকেতু ব্রহ্মবিদ্যা জানতে চায়। বাবা বললেন, তুমি দিন পনেরো না খেয়ে থাক। শ্বেতকেতু তাই করলেন। পনেরো দিন পরে ঋক, সাম, যজুঃ কোনও বেদই মনে পড়ল না। অতঃপর বাবার আদেশে খাওয়াদাওয়া করে এলেন এবং দার্শনিক বিদ্যায় স্বচ্ছন্দে বিহার করলেন। বাবা বুঝিয়ে দিলেন, মন অন্নময়। প্রাণ, আশা, স্মৃতি, আকাশ, তেজের চেয়েও অন্ন শ্রেষ্ঠ।
কাপড়ও দার্শনিক বাদ-বিবাদে কম ভূমিকা নেয়নি। কাপড় মানে শুধু ধুতি বনাম ট্রাউজার্স বা কাঞ্জিভরম বনাম গাদওয়াল নয়। কাপড় মানে, সুতোয় তৈরি। ন্যায়-দার্শনিকরা অন্তত সে দিকেই ইঙ্গিত করতেন। এই যে সুতোর সন্নিবেশে তৈরি কাপড়... সুতো থেকে কখনওই একে বিযুক্ত করা যাবে না। সুতো অবয়ব। আস্ত কাপড়টা অবয়বী। বৌদ্ধ দার্শনিকরা আবার বলতেন, কাপড় অবয়বী নয়। স্রেফ সুতোরূপী অবয়বের পুঞ্জ।
অরিন্দম চক্রবর্তীর নতুন বই সেই ঐতিহ্য মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। দর্শন মানে শুধু পাত্রাধার তৈল বা তৈলাধার পাত্রের কূটকচালি নয়, রোজকার বেঁচে থাকাতেই খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। “আজ মননের জগতে চিন্তার যে সর্বব্যাপী শৈথিল্য, তার বিরুদ্ধে অরিন্দমের বইটা অকুণ্ঠ মেধাবী প্রতিবাদ,” বলছেন ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র।
বাংলা বইয়ের জগতে এই মেধার প্রথম প্রকাশ ২০০৮ সালে। সে বছরেই বেরোয় অরিন্দমের প্রথম বাংলা বই: ‘দেহ গেহ বন্ধুত্ব’। অতঃপর একে একে ‘মননের মধু’, ‘ভাতকাপড়ের ভাবনা’, ‘তিন কাল’। তার আগে সংস্কৃতে লিখেছেন, ‘আধুনিক-প্রতীচ্য-প্রমাণ-মীমাংসা’। অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নিয়ে ইংরেজিতে ‘ডিনাইয়িং এগজিসটেন্স’। কয়েক মাস পরেই ইংরেজি ভাষায় বেরোতে চলেছে তাঁর ‘বুক অব কোয়েশ্চেনস’। সেখানে থাকছে ভারতীয় দর্শন আর অ্যানালিটিক ফিলজফির সেতুবন্ধন। “অরিন্দমের বৈশিষ্ট্য এখানেই। সংস্কৃত, ইংরেজি এবং বাংলা তিনটি ভাষাতেই বই লিখেছেন, এমন কাউকে অন্তত আমি জানি না,” বলছেন সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ সংস্কৃতিবিদ্যার শিক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়।
অথচ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনে এই বহুভাষিক গতায়াত ছিল বাঙালির স্বচ্ছন্দ বিহার। গৌতম ভদ্র এই অধুনালুপ্ত ধারাটিকেই ধরিয়ে দিচ্ছেন “উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে গত শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ থেকে শশিভূষণ দাশগুপ্ত, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনার যে সমৃদ্ধ ধারাকে পুষ্ট করেছিলেন, অরিন্দমের বইটি তারই পুনরুজ্জীবিত ফসল।” প্রসঙ্গত এই বছরেই ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সার্ধশতবার্ষিকী। তিনি শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশে দর্শনের প্রথম অধ্যাপক। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘কিং জর্জ প্রফেসর অব মেন্টাল অ্যান্ড মরাল সায়েন্স’। সেই শতবর্ষও পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় নীরবে। স্মৃতিভ্রংশে আচ্ছন্ন এই সমাজে অরিন্দম চক্রবর্তীর আনন্দ-সম্মান তাই জ্ঞানচর্চায় অধুনালুপ্ত এক ঐতিহ্যের পুনরাবলোকন।
আর, ব্যক্তি অরিন্দম! তিনি নিজেই বহুভাষিক, বহুমুখী প্রতিভার লুপ্তপ্রায় উদাহরণ। চার বছর বয়সে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথের কাছে দীক্ষা, নিরামিষাশী। এখন শার্ট-ট্রাউজার্স পরেন, কিন্তু ধুতি-পাঞ্জাবিই ছিল তাঁর দীর্ঘকালীন পোশাকি ঐতিহ্য। প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিনে তাঁর সমসাময়িকরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন, ‘খাদি প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ভরসা, ক্ষৌরকর্মে অপারগ।’ নিরামিষের পাশাপাশি স্বপাক আহার করতেন। সেই থেকে চমৎকার রান্নার হাত। পেঁয়াজ, রসুনের স্পর্শহীন সুস্বাদু নিরামিষ।
রান্নার পাশাপাশি ছবি আঁকা, মূর্তি গড়াতেও কম যান না। হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় লালুপ্রসাদ শ’র কাছে ছবি আঁকতেন। শিক্ষক, ছাত্রের সেই ছবি নিয়ে ১৯৬৯ সালে স্কুলের দেড়শো বছর পূর্তিতে একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তাঁর মাস্টারমশাই বিমলকৃষ্ণ মতিলালের বাড়িতে একটি সরস্বতী মূর্তি গড়ে পুজো করেছিলেন। ‘উক্ষতারণে’ (ম্যাক্সমুলার অক্সফোর্ডের সংস্কৃত এ রকমই করেছিলেন) সেই মূর্তি বেশ কিছু দিন এক বন্ধুর ঘরে রাখা ছিল। সেই বন্ধু পরে ইংরেজির শিক্ষক অম্লান দাশগুপ্ত!
মূর্তিশিল্পীর গলায় সুর ছিল, নামগান গাইতেন চমৎকার। সব দার্শনিকেরই বোধ হয় এক জন প্রিয় সঙ্গীতকার থাকেন। নিটশের যেমন হ্বাগনার, উইটগেনস্টাইনের মোৎসার্ট। অরিন্দমের ক্ষেত্রে উস্তাদ আমির খান। নিজে শুনেছেন, অন্যদেরও শুনিয়ে ছেড়েছেন। “একটা সময় অরিন্দম আর আমি একটা ঘরে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। ঘরটায় খান পনেরো মুরগিও থাকত। আমি সবচেয়ে বেশি উস্তাদজির গান শুনেছি ওর কাছ থেকেই,” বলছিলেন অজয় চক্রবর্তী।
বহুমুখী এই প্রতিভাতেই মিশে আছে ফিচেল কৌতুক। বছর কয়েক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের সেমিনার। ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনে বল নিয়ে আলোচনা করছেন অরিন্দম। গুরুগম্ভীর আলোচনার মাঝে, “আমার আত্মীয়ের এক হাফ-কাস্ট্রেটেড কুকুর ছিল। উনি তার নাম দিয়েছিলেন মোনো-বল।” দার্শনিক মানে যে রামগরুড়ের ছানা হওয়া নয়, সেই বিষয়ে দ্বিতীয় বই ‘মননের মধু’তে চমৎকার বুঝিয়েছিলেন অরিন্দম, ‘‘কৌতুকের কাজ সত্যের স্বভাবসিদ্ধ চাতুরীর বর্ম ভেদ করে আমাদের অহংমোহে ফাটল ধরিয়ে দিগম্বর সত্যের একটু কাছাকাছি এনে দেওয়া।’’ শব্দ নিয়ে কৌতুকই তাঁর অভিজ্ঞান। ভাতকাপড়ের ভাবনায় যেমন ইংরেজি ‘আই-ডল’ শব্দটি ভেঙে বাংলা করেন ‘আত্মা-পুতুল’। কখনও বলেছেন ‘অহং ফোন’ আর ‘অহং প্যাড’-এ বদ্ধদৃষ্টি জীবের কথা। শব্দ নিয়ে এটি তাঁর পুরনো খেলা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক মণিদীপা সান্যাল তাঁর ছাত্রী। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, মাস্টারমশাই এক দিন ক্লাসে সময় কী, অতীত কী, আমরা শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক হয়ে এগোই, নাকি আসলে সময়টাই এগোয়, ইত্যাদি নানা সমস্যা উত্থাপন করলেন। তার পর মোদ্দা কথাটা বুঝিয়ে দিলেন, ‘প্রেজেন্ট ইজ দ্য প্রেজেন্ট অব টাইম।’
ঘটমান বর্তমান, উপহার সবই ধরা রইল ওই ইংরেজি শব্দে।
সেই কৌতুক, প্রজ্ঞা আর ন্যায়বোধের ইন্ধনেই রান্না হয়েছে দার্শনিকের বহুমুখী ভাবনা। ভাতকাপড়ে শুরু, তার পর একে একে চলে গিয়েছেন প্রতিশোধ, আত্মহত্যা, হিংসে-ঈর্ষা-অসূয়ার মনোদর্শনে। লেখকের বক্তব্য: কী খাব, কী পরব, সেটা দর্শন-ভাবনা নয়। কিন্তু খাওয়া-পরা থেকে কী করে উপনিষদ বা ন্যায়ের কথা ভাবতে পারি এই জাতীয় আত্মবিচারই দর্শন। ভাবনার আত্মসম্মুখীকরণ। “এক দিকে ভাতকাপড়ের মতো আটপৌরে জিনিসকে দর্শনভাবনার স্তরে নিয়ে আসা, অন্য দিকে দর্শনকেও আটপৌরে স্তরে নিয়ে যাওয়া। লঘুগুরুর বিমিশ্রণ ও বিনিময়। এখন অবধি অরিন্দমের সবচেয়ে সংহত বই,” বলছেন শিবাজী।
সেই সংহত দার্শনিক গ্রন্থনাতেই অর্পিত হল এ বারের আনন্দ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy