সারদা-কাণ্ডে চাপ বাড়ানো অব্যাহত রাখল বামেরা। রাজ্য সরকারের পাশাপাশি তারা আঙুল তুলল দিল্লির দিকেও। অন্য দিকে, সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করা ছাড়া সারদা-কাণ্ড নিয়ে আর বিশেষ কিছু বললেন না তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং, এ বার তাঁর প্রচারে বেশি জায়গা পেল উন্নয়ন সংক্রান্ত দাবি। বিরোধীরা যখন সারদা-অস্ত্রে শাসক দলকে বিঁধতে চাইছে, তৃণমূল তখন উন্নয়নের পরিসংখ্যানকে হাতিয়ার করে নজর ঘোরাতে চাইছে অন্য দিকে দ্বিতীয় পর্বের ভোট মিটে যাওয়ার পরে এই রকমই দাঁড়াল নির্বাচনী ময়দানের ছবি।
বর্ধমানে প্রচারে গিয়ে এবং ফেসবুকের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ১০০ দিনের প্রকল্পে টাকা খরচের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গই এখন দেশের মধ্যে এক নম্বর। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওয়েবসাইট থেকেই ওই তথ্য জানা যাচ্ছে বলে ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন মমতা। ফেসবুকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে ৫৫২১ কোটি টাকা খরচ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে বাংলা। এর মধ্যে ১৮১৫ কোটি টাকা এখনও কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি বলেও মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ।
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, প্রথম দুই পর্বে রাজ্যের যে ১০টি আসনে ভোট হল, তার কোনওটিই শাসক দলের হাতে ছিল না। কিন্তু তৃতীয় পর্ব থেকে যে ৩২টি আসনে ভোট হবে, সেখানে তৃণমূলের দুর্গরক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে রাজ্যে মমতার সরকারের নেতৃত্বে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের কথা বললেই বেশি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে তৃণমূল শিবিরের আশা। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “এত দিন বিরোধীরা সারদা নিয়ে বলছিল আর আমরা জবাব দিচ্ছিলাম। এখন আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, তথ্য দিচ্ছি। আমাদের ইতিবাচক প্রচারের সঙ্গে বিরোধীদের নেতিবাচক বক্তব্যের যে লড়াই হচ্ছে, সেটা মানুষ দেখবেন!”
ফেসবুক পোস্টের মতোই বর্ধমানের উৎসব ময়দানের সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “এ বারও রাজ্য ১০০ দিনের প্রকল্পে দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। গত কালই এই চিঠি মিলেছে। অথচ আমাদের এই কৃতিত্বের কথা আমাদের রাজ্যেই কেউ প্রচার করে না!” নরেন্দ্র মোদীর নাম না-করেই মমতার কটাক্ষ, “অনেকে গুজরাত-গুজরাত করছেন! তাঁরা জানেন না, এই প্রকল্পে গুজরাত মাত্র ৫০০ কোটি খরচ করেছে। আর আমরা করেছি ৫ হাজার কোটি। ওই রাজ্যের চেয়ে আমাদের মাথা পিছু আয় বেশি, শিশুমৃত্যুর হার কম। তবু লোকে গুজরাত নিয়ে লাফালাফি করে!”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিনই অভিযোগ করেছেন, “১০০ দিনের কাজের টাকায় উন্নয়ন হচ্ছে কোথায়? পঞ্চায়েতে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। ভিলেজ পুলিশ, সিভিক পুলিশদের কিছু দিন কাজ করিয়ে আবার বসিয়ে রাখা হচ্ছে। রাজ্যটাকে নিয়ে কী চলছে?” তৃণমূলের পাল্টা হিসাবে বিমানবাবু আবার জনতার কাছে আর্জি জানিয়েছেন, “ওদের প্রশ্ন করুন, রাজ্যকে নিয়ে কী করছেন আপনারা? এই ভোটে রাজ্যে সরকার বদলাবে না। কিন্তু এই সরকারকে একটা বার্তা দেওয়া যাবে, এই চেষ্টা নিয়ে বাকি ৩২ কেন্দ্রে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন!”
এরই পাশপাশি বামেরা অবশ্য সারদা থেকেও নিশানা সরায়নি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, সারদা কেলেঙ্কারির মতো ‘মেগা লুঠে’র সঙ্গে জড়িত রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের কর্তাব্যক্তিদের বাঁচাতেই সিট গত এক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েছে। ইডি-র তৎপরতা ঠেকাতে যে ভাবে সিট লকার খুলেছে, তার পরে আর রাজ্য সরকারের তদন্তে কারও কোনও আস্থা নেই বলে সূর্যবাবু মন্তব্য করেছেন। আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি বজায় রাখার পাশাপাশি এ দিন আবার অনেকটা তৃণমূল নেত্রীর সুরেই দিল্লির দিকেও আঙুল তুলেছেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর কথায়, “কেন্দ্র এত দিন দায় এড়িয়ে গিয়েছে। আসল লোক দিল্লিতে বসে আছে!” এই ইঙ্গিত কার দিকে? সূর্যবাবুর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রীর ভাষা ধার করেই বলছি, ইশারাই কাফি হ্যায়!” তাঁর আরও বক্তব্য, “রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্ত চাই। কান টানা হয়েছে শুধু। আমরা চাই, মাথাটাও যাতে ঘোমটার আড়ালে না থাকে!”
এ সবের প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন শুধু ছুঁয়ে গিয়েছেন সারদা-প্রসঙ্গ। কাটোয়ার সভায় সারদার নাম উল্লেখ না-করেই তিনি বলেছেন, “সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করিয়ে কোনও লাভ হবে না। জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ড, নন্দীগ্রাম, নেতাই, ছোট আঙারিয়া কাণ্ডগুলোতে সিবিআই তদন্ত করেছে। কিন্তু বিচার হয়নি।”
বর্ধমান জেলায় এ দিন সমুদ্রগড়, কাটোয়া ও শেষে বর্ধমান শহরে তিনটি সভা ছিল তৃণমূল নেত্রীর। কাটোয়ার সভায় খানিক বিশৃঙ্খলা হয়। মমতা বক্তৃতা করা বন্ধ করে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “এ রকম করলে সভা করব না!” তা সত্ত্বেও বিশৃঙ্খলা থামছে না দেখে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।