Advertisement
E-Paper

রং-রস-গান-পানের বাহারে মিশল বসন্ত-বিলাপও

উত্তর কলকাতার লাহা কলোনির বাতাসে সাতসকালেই ‘রঙিন’ অভিযোগ! রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের লাগোয়া রাস্তায় ডিও-ফিও মেখে ‘ঘ্যামা’ নীল টি-শার্টে সবে পদার্পণ ঘটেছে ভূমিপুত্র সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের। তেতলার ছাদ থেকে এক বালতি রঙিন জল তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে স্বাগত জানাল। মেয়েদের পেয়িংগেস্ট হস্টেলের বাড়িটার দিকে তাক করে এর পরেই প্রায় নিউটনের সূত্র উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধা! পিচকিরির কামান অদৃশ্য নিশানা ভেদ করার চেষ্টা করে নীচেই ফিরে এল। কয়েকটা বেলুন ছাদের গায়ে হামলা চালাল। ঠিক যেন এক টুকরো ‘বসন্ত-বিলাপ’!

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৫ ০২:২৬
গল্ফ গ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

গল্ফ গ্রিন সেন্ট্রাল পার্কে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।

উত্তর কলকাতার লাহা কলোনির বাতাসে সাতসকালেই ‘রঙিন’ অভিযোগ!

রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের লাগোয়া রাস্তায় ডিও-ফিও মেখে ‘ঘ্যামা’ নীল টি-শার্টে সবে পদার্পণ ঘটেছে ভূমিপুত্র সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের। তেতলার ছাদ থেকে এক বালতি রঙিন জল তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে স্বাগত জানাল।

মেয়েদের পেয়িংগেস্ট হস্টেলের বাড়িটার দিকে তাক করে এর পরেই প্রায় নিউটনের সূত্র উড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধা! পিচকিরির কামান অদৃশ্য নিশানা ভেদ করার চেষ্টা করে নীচেই ফিরে এল। কয়েকটা বেলুন ছাদের গায়ে হামলা চালাল। ঠিক যেন এক টুকরো ‘বসন্ত-বিলাপ’!

বৃহস্পতিবার দুপুরে ত্রিশোর্ধ্ব সন্দীপ, বিশ্বজিৎ, ভিকি, বাদশাদের কাছে এই সংঘাতের গপ্পো শোনা গেল। দোল-সকালের নাট্যমুহূর্তটুকু অবশ্য বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। বেলা ২টো নাগাদ সন্দীপদের ঠেক থেকে কয়েক পা দূরে হস্টেল-চত্বরে গিয়ে দেখা গেল, নারী-বাহিনীর দোল খেলা ইতিমধ্যে শেষ। কেউ কেউ চানও সেরে ফেলেছেন।

সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিরত দুর্গাপুরের পূর্বাশা আন, পুরুলিয়ার পূর্বা দাঁ, শিলিগুড়ির এমএ পড়ুয়া সোনিতা পাহাড়িরা বললেন, হস্টেলের যা নিয়ম, দোলে সাধারণ ভাবে রাস্তায় বেরোনো যাবে না। সবাই ছাদেই রং মেখেছেন। এ তল্লাটে ছাত্রীদের ‘পঞ্জাবি আন্টি’র নিয়মটাই ধার্য। হস্টেলে তাই দোলের দুপুরে মিষ্টি খাওয়া হলেও আমিষ ঢুকবে না।

সামনের রাস্তায় পুরুষ-বাহিনীর ম্যাচ অবশ্য তখন ‘মধ্যান্তর’ পর্যন্তও গড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজের ব্যবসা থেকে ছুটি নিয়ে বিশ্বজিৎ ভোর ৫টায় শোভাবাজার থেকে মাংস কিনে এনেছেন। উদ্দাম রং খেলার অনুষঙ্গে চিকেন পকোড়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। মাংসের ডেকচি চাপানো হয়েছে চিলতে ক্লাসঘরে। পকোড়ার টাকনার সঙ্গে চলছে আয়েশি চুমুক।

বুধ-রাতে হাওড়ার ‘ফরেন লিকার’ বিপণীর কর্মচারী তরুণ পাণ্ডা কাহিল স্বরে বলছিলেন, উৎসবের প্রস্তুতিতে জনগণের বিপুল ‘রেশন’ তোলার চাহিদা। আর দোলের দুপুরে বড়বাজারে গিয়ে দেখা গেল, কলাকার স্ট্রিটে জৈন মন্দিরের কাছের দোকানের মুকেশ-মনজিতেরা একনাগাড়ে চাহিদামাফিক ভাঙের জোগান দিতে জেরবার হচ্ছেন।

এক ধারে টুল পেতে আগাম টাকা মিটিয়ে কুপন কাটার বন্দোবস্ত। তার পরে চাহিদামাফিক শরবতের জন্য দোকানের সামনে লাইন দিয়ে উঁচুতে হাত বাড়িয়ে রাখা। দাম সব শরবতেরই এক। কিন্তু বন্দোবস্ত তিন কিসিমের। দুধের সর ভরপুর হলুদরঙা শরবতটি নির্দোষ, সাদা। কিন্তু হলুদের রংটা একটু একটু করে ফিকে হয়ে কালচে হতে শুরু করেছে আরও দু’ধরনের গেলাসে। ‘মিডিয়াম’ ও ‘কড়ওয়া’ শরবতও রয়েছে।

তৃষ্ণার্তদের মধ্যে কারও কারও চাপা ভয়ও রয়েছে। কতটা মেশালে সহনীয় হবে, এক বার নেশা গাঢ় হলে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে চলছে দেদার জল্পনা। তরলের সঙ্গে সিদ্ধির লাড্ডুও বিকোচ্ছে ঢালাও।

শিবলোকের পানীয় বলে খ্যাত ভাঙের ব্যাপারে হিন্দিভাষীদের মতো ‘বঙ্গালিদের’ উৎসাহও যে কোনও অংশে কম নয়, মালুম হচ্ছিল বিলক্ষণ। কেষ্টপুর থেকে আসা সুরজিৎ দাস, পঙ্কজ বিশ্বাসেরা কয়েক গেলাস চোঁ চোঁ করে মেরে বোতল ভরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এন্টালি থেকে এসেছে একটা বড় দল। সকলেই মাঝবয়সি। কিন্তু উৎসাহে ছোটদেরও উড়িয়ে দেবেন। জয়দীপ দত্ত ঠান্ডাইয়ের বোতল এবং ভাঙের গুঁড়ো আলাদা আলাদা নিলেন। বললেন, “গিন্নির হুকুম! বলে দিয়েছে, তোমরা শুধু নিজেরা ও-সব খেয়ে মজা করবে, সেটি হচ্ছে না।”

শান্তিনিকেতনের আদলে বসন্ত-উৎসবে এখন কলকাতাও কারও থেকে কম যায় না। সকাল থেকে গল্ফগ্রিন-সল্টলেকে জমে উঠেছে ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়’! বেলা যত গড়িয়েছে, ফাগুনের নেশা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির ঠাকুরদালানে রাজবেশে সজ্জিত কেষ্টঠাকুরকে নিয়ে মাতামাতি সকাল সকাল শেষ। গুরুজনের পায়ে আবির দেওয়ার প্রথা খানিকটা টিকে আছে শহরে। কিন্তু বেলা গড়াতেই চার পাশে ‘রং বরসে’র মেজাজ।

শ্যামবাজারের এক রংবিক্রেতার মন তবু ভাল নেই। ধুর, দোলের রং এ বার অন্য বারের অর্ধেক বিক্রি হয়েছে। বেলা ১০টা নাগাদ যাদবপুর বাজারে কিন্তু দেখা গেল, এক মা তাঁর ছ’বছরের পুত্রের পেন্সিলে এঁকে দেওয়া পিচকিরির ছবির কাগজ হাতে ঘুরছেন। ঠিক তেমনটি না-পেলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।

চেনা-অচনার গণ্ডি ভুলে রং মাখামাখিও এন্তার! সদর স্ট্রিটে মালয়েশিয়া থেকে আসা এক দল চিনা তরুণ-তরুণী রং মেখে ভাবছেন, কী করে এ-সব তুলতে হবে! পথের ধারে পরামর্শ পেলেন, নারকোল তেল মাখার। সুইস তরুণ-তরুণী ম্যাক্স আর সোফি দু’দিন বাদে সুন্দরবনে বেড়াতে যাবেন। কলকাতা সফরে প্রথম বারের দোল-অভিজ্ঞতা চাখার সুযোগ পেয়ে তাঁরা রীতিমতো পুলকিত। হামবুর্গের মেয়ে পিয়া অবশ্য এখন ‘কলকাতার মেয়ে’ই হয়ে গিয়েছেন। দু’মাস ধরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে শহরে রয়েছেন তিনি। জার্মান কন্যেকে সদর স্ট্রিটের ফুটপাথবাসিনী হাসিনা, আশারা ডাক দিয়েছেন সকাল সকাল। সারা সকাল একসঙ্গে রং খেলার পরে বিকেলে চান করে তা তুলে ফেলার পরে হাসিনাই পিয়ার হাতে ফের মেহেন্দি পরাতে বসলেন।

বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। সীমিত যানবাহন। আপাত নির্জন শান্ত শহর জুড়ে উৎসবের চোরাস্রোত তবু রঙে রঙে প্রবাহিত হল। দিনভর তেমন বড়সড় ঘটন-অঘটন নেই। চোখে-মুখে বিচিত্র আলপনায় রংমাখা সং হয়েই হয়তো না-পাওয়ার সব রং মুছতে চাইল কলকাতা।

dol riju basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy