Advertisement
E-Paper

স্বাভাবিক নেই কিছু, ধরা পড়ল মুকুলেই

কর্মীদের অভিবাদনের জবাবে হাতটা শুধু তুলছেন। কাষ্ঠ হাসির রেখা একটু ফুটলেও দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে ফ্রেঞ্চকাটের আড়ালে। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। বহু সাধাসাধির পরে এক কাপ লিকার চায়ে ঠোঁট ডুবিয়েছেন। মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কর্মিসভায় সাকুল্যে ১৩ মিনিটের বক্তৃতা। কোনও রকমে প্রথম কর্মিসভা সেরে দ্বিতীয়টি বাদ রেখে বিমানবন্দরের দিকে দৌড়। দিল্লির বিমান ধরতে হবে যে!

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৮
নজর সময়ে। রবিবার বনগাঁয় তৃণমূলের সভায় মুকুল রায়।

নজর সময়ে। রবিবার বনগাঁয় তৃণমূলের সভায় মুকুল রায়।

কর্মীদের অভিবাদনের জবাবে হাতটা শুধু তুলছেন। কাষ্ঠ হাসির রেখা একটু ফুটলেও দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে ফ্রেঞ্চকাটের আড়ালে। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। বহু সাধাসাধির পরে এক কাপ লিকার চায়ে ঠোঁট ডুবিয়েছেন। মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কর্মিসভায় সাকুল্যে ১৩ মিনিটের বক্তৃতা। কোনও রকমে প্রথম কর্মিসভা সেরে দ্বিতীয়টি বাদ রেখে বিমানবন্দরের দিকে দৌড়। দিল্লির বিমান ধরতে হবে যে!

দুর্ভাবনাগ্রস্ত, এমন উদভ্রান্ত মুকুল রায়কেই রবিবার দেখলেন বনগাঁর তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা! যে বনগাঁর লোকসভা উপনির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সিবিআইয়ের কাছে সময় চেয়ে নিয়েছেন শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। কাজের ‘ব্যস্ততা’ দেখিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু হাবভাব এবং শরীরী ভাষার অস্বাভাবিকতাই তো দেখিয়ে দিচ্ছে, মুকুল স্বাভাবিক নেই! যেমন স্বাভাবিক নেই তাঁর দলও।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেমন ঠিক ছিল, আজ, সোমবার ফের দিল্লি যাবেন মুকুল। কিন্তু এ দিন বিকালে বনগাঁর চাঁদপাড়ায় নির্ধারিত আরও একটি কর্মিসভায় হাজিরা না দিয়েই দিল্লির বিমান ধরতে চলে গেলেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী! যে খবর পরে পেয়ে দলে রাজ্য নেতৃত্বে তাঁরই এক সহকর্মীর বিস্ময়, “চলে গিয়েছে? কখন কী হচ্ছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! হয়তো সুপ্রিম কোর্টে মামলা করার তাড়া আছে!” কিন্তু এ সব করতে থাকলে সিবিআইয়ের দফতরে যাবেন কবে? প্রশ্নের জবাবে মুকুল এ দিন বলেন, “এ ব্যাপারে দলই সিদ্ধান্ত নেবে। দলের মুখপাত্র আছেন। তিনিই জানাবেন।” দলের তরফে কেউই মুকুলের সিবিআই-যাত্রা প্রসঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে কিছু বলতে চাননি। পরিস্থিতি যে অস্বাভাবিক, এ তারই আর এক ইঙ্গিত!

সব যখন স্বাভাবিক ছিল, মুকুল বনগাঁয় এলেই আগে-পিছে মোটরবাইক, গাড়ির কনভয় থাকত। এ বার তেমন কিছু নেই। বরং, বাটার মোড়ের কাছে গাড়ি থেকে নেমে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বনগাঁ-চাকদহ সড়ক ধরে মিনিট কুড়ি হেঁটে এ দিন শহরে ঢোকেন মুকুল। হঠাৎ কেন হাঁটা পথে? দলেরই কেউ কেউ বলছেন, “পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, ভোটের আগে দাদার আর প্রচারে আসা হবে কি না, তার ঠিক নেই। তাই রোড-শোটাও সেরে গেলেন হয়তো!” পরিস্থিতি যে অস্বাভাবিক!

আগের মতো সব স্বাভাবিক থাকলে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের মোকাবিলায় নিজের দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককেই এগিয়ে দিতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইদানীং মুকুলকে পিছনে ঠেলে তিনি মাঠে নামাচ্ছেন ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আগামী বুধবারও বর্ধমানের একই মাঠে অমিতের পাল্টা সভায় তৃণমূলের মুখ্য বক্তা অভিষেক। সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুব্রত বক্সী। তালিকা থেকে মুকুল হাওয়া! দলেরই এক নেতা বলছেন, “মুকুল কবে কোথায় থাকবে, তার ঠিক নেই! তার চেয়ে এই টিমই ভাল!” তৃণমূল ভবনে আজ, সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনও করার কথা সেই যুবরাজেরই। পরিস্থিতি যে অস্বাভাবিক!

সব যখন স্বাভাবিক, নির্বাচনী কর্মিসভায় মুকুল অভিযোগ করতেন, রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের দলনেত্রীর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। তাঁদের ফাঁসাতে চাইছে। কিন্তু এখন? এখন কর্মিসভায় বলে ফেলছেন, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিংবা তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী হিসেবে কোনও অনৈতিক কাজ করিনি।” দলেরই কর্মী-সমর্থকেরা প্রশ্ন তুলছেন, কর্মিসভায় হঠাৎ এমন আত্মপক্ষ সমর্থন কেন? দলের কর্মীরা তাঁকে অবিশ্বাস করেন? উত্তরও দিচ্ছেন কর্মীরাই। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “সব সময় এই চিন্তাটাই আসলে দাদাকে কুরে কুরে খাচ্ছে! তাই বলে ফেলছেন!” অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই তো এমন হয়!

চলছে বক্তৃতা। রয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি কিন্তু অন্য দিকে।

বনগাঁয় তৃণমূলের দফতরে জেলার কিছু নেতার সঙ্গে মিনিট পনেরো একান্তে কথা বলেছেন মুকুল। প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ, বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মমতা ঠাকুরকেও দেখা গিয়েছে সেখানে। তৃণমূলেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, সেখানে মুকুলকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আমার যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, এই আসনে জিততেই হবে’! বেশ খানিক ক্ষণ পরে সেখানে আসেন জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। দু’জনে পাশাপাশি বসলেও বেশির ভাগ পরামর্শ-নির্দেশ আসছিল জ্যোতিপ্রিয়বাবুর কাছ থেকেই। বনগাঁ উপনির্বাচনে দলের দায়িত্ব পেলেও মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসকে এ দিন মুকুলের ধারে-কাছে দেখা যায়নি। আর মুকুলকে দলীয় দফতরে মাঝেমধ্যেই চুপ করে বসে দাঁতে নখ কাটতে দেখা গিয়েছে! স্বাভাবিকতার লক্ষণ নিশ্চয়ই নয়!

কর্মিসভায় এক বারের জন্যও চেয়ারে বসতে দেখা যায়নি রাজ্যসভার সাংসদকে। প্রায় আধ ঘণ্টা ছিলেন মঞ্চে। নিজে বলেছেন মিনিট তেরো। গোটা সময়টাই ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিলেন। মাঝে মাঝে দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল উপরের দিকে। দলের দফতরে থাকাকালীনও পরপর খানতিনেক সিগারেট দেখা গিয়েছে মুুকুলের হাতে! এ পর্যন্ত ক’টা হল? সামান্য হেসে মুকুলের উত্তর, “চার-পাঁচটা হবে! তবে আমি তো এমনই খাই।”

বিরোধীরা অবশ্য মনে করছে না যে, সব এমনি এমনি হচ্ছে! তাঁর হঠাৎ বনগাঁ যাওয়া, ফের তড়িঘড়ি দিল্লি ফেরা এ সবে অস্বাভাবিকতার গন্ধই পাচ্ছে তারা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু যেমন এ দিন বলেছেন, “বিজেপি নেতারাই বলছেন, মুকুল তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি নিজে দিল্লি-কলকাতা করছেন। মনে হচ্ছে, উপরে উপরে যত লড়াই-ই হোক, তৃণমূল-বিজেপি খেলাটা হয়তো গড়াপেটার দিকেই গড়াচ্ছে!” বিজেপি সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য বোঝাচ্ছেন, “ধরাধরি করে কিছু হবে না। আইনের হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না!”

রেহাই যে সহজ নয়, বুঝে গিয়েছেন কি মুকুলও? নইলে বনগাঁ শিমুলতলার মাঠে কর্মিসভার বক্তৃতায় মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে সহসা কেন বলবেন, “আমি এই জেলারই ছেলে। আমি জানি, দীর্ঘ দিন ধরে এখানে বালু (জ্যোতিপ্রিয়র ডাক নাম) কেমন বুক চিতিয়ে আন্দোলনটা করেছে!” ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থেকেই কি ‘জেলার ছেলে’র হাতে বনগাঁ-ভোটের ব্যাটনটা দিয়ে গেলেন কাঁচরাপাড়ার ভূমিপুত্র?

হতেই পারে! পরিস্থিতি তো স্বাভাবিক নয়!

ছবি: সুমন বল্লভ

saradha scam mukul roy bangaon byelection simanta maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy