Advertisement
E-Paper

হেমন্তের উত্‌সব কার্তিকপুজো

নদী তীরবর্তী অঞ্চলে মূলত বণিক, বন্দর এবং বারাঙ্গনা এই তিন সংসর্গ কার্তিকপুজোর শুরুর কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য। শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটে।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ১৯:৫২
জোড়াসাঁকোর নরসিংহচন্দ্র দাঁ-এর পরিবারের কার্তিক।

জোড়াসাঁকোর নরসিংহচন্দ্র দাঁ-এর পরিবারের কার্তিক।

সেই ঠাকুরের সঙ্গে অতীতের ‘ফুলবাবুর’ তুলনা করা হয়!

পরনে কোঁচানো ধুতি, গায়ে দামি চাদর। গোঁফ এবং কেশের বিন্যাসও চমত্‌কার। তাই তো কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’-য় লিখেছিলেন, “উঁচুগতি কার্তিকের মত বাউরি চুল।”

পুরাণে তাঁর উল্লেখ মেলে বীর দেবসেনাপতি রূপে। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তিনি কামুক এবং লম্পট রূপেই বর্ণিত। ঋগ্বেদে তাঁর নাম ‘কুমার’। দক্ষিণ ভারতে তিনি কখনও সুব্রহ্মণ্য, কখনও বা মুরুগণ নামে পূজিত। আর বাংলায় তিনি বাবু কার্তিক। বাঙালির সরল বিশ্বাসে তিনি বন্ধ্যানারীর প্রজনন ক্রিয়ার পরোক্ষ কারণ।

প্রাচীন ভারতে যুগ যুগ ধরে পূজিত হয়েছেন কার্তিকেয়। সেই মৌর্য-শুঙ্গ যুগ থেকে ভারতের শিল্পে মিলেছে তাঁর পাথুরে প্রমাণ। এ ছাড়াও প্রাচীন মুদ্রায় মিলেছে কার্তিকের মূর্তি। অথচ এক সময় উচ্চবর্ণের মানুষ এই পুজোকে ব্রাত্যজনের পুজো বলে চিহ্নিত করতেন। তবুও কালের স্রোতে বাঙালির কার্তিক আরাধনার ইতিহাস বৈচিত্রপূর্ণ।


জোড়াসাঁকোর লালাবাবুর বাড়ির কার্তিক পুজো।

নদী তীরবর্তী অঞ্চলে মূলত বণিক, বন্দর এবং বারাঙ্গনা এই তিন সংসর্গ কার্তিকপুজোর শুরুর কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। সাধারণত গণিকাদের সন্তানাদি হত না। তাঁদের মনের মাঝে সুপ্ত অথচ অতৃপ্ত বাসনার কারণ এই পুজো। তাঁদের মধ্যে জেগে থাকা মাতৃচেতনা চাইত পরজন্মে মা হতে, তাই এই পুজো। আবার মতান্তরে গণিকারা নিজেদের কার্তিকের বাগদত্তা মনে করেন, তাই কার্তিকের মতো রূপবান বাবু লাভের কামনায় বারাঙ্গনা সমাজে এই পুজো এত ধুমধাম করে হয়ে থাকে। এ পুজো তাঁদের নিজস্ব বিনোদন।

কলকাতাতে নানা প্রভাবে শুরু হয়েছিল পারিবারিক কিছু কার্তিক পুজো। গবেষকদের মতে সেটা ছিল মূলত বংশ রক্ষার্থে বা পুত্র কামনায়। যেমন জোড়াসাঁকোর নরসিংহচন্দ্র দাঁ-এর পরিবারে দুর্গাপুজোর শুরু হওয়ার কিছু কাল পরেই শুরু হয় কার্তিক পুজো। এই পরিবারের সন্দীপকুমার দাঁ জানালেন, খুব সম্ভবত এই পুজো শুরু করেছিলেন নন্দলাল দাঁ। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান এবং তাঁর সম্পত্তি দেবোত্তর করে গিয়েছিলেন। এই পরিবারের রীতি অনুসারে কার্তিক ঠাকুরের রূপ ছোট বালকের মতো। তাকে পরানো হয় কমলা রঙের জোড়।

অন্য দিকে, খেলাত্‌চন্দ্র ঘোষের বাড়ির কার্তিক পুজোয় দেখা যায় বাবু কার্তিক। তাঁর পরনে কোঁচানো ধুতি, গায়ে দামি শাল। পিছনে থাকে ময়ূরের পালকের চালচিত্র। সিমলে অঞ্চলের তারকনাথ প্রামাণিকের বাড়ির কার্তিকপুজো শুরু হয়েছিল হুগলি জেলার সাহাগঞ্জে। পরবর্তী কালে মদনমোহন প্রামাণিক কলকাতার বাড়িতে সেই পুজোর প্রচলন করেন। সিংহাসনের উপর বাবু কার্তিকের অধিষ্ঠান। নীচে থাকে তিনটি ময়ূর। শোনা যায়, এই পরিবারেও সন্তান কামনায় শুরু হয়েছিল এই পুজো।

তবে শুধু বাঙালি পরিবারেই নয়, অবাঙালি পরিবারেও আছে কার্তিক পুজোর প্রচলন। যেমন, জোড়াসাঁকোর লালাবাবুর বাড়ির পুজো। লাহৌর থেকে মুর্শিদাবাদে আসেন এই পরিবারের আদিপুরুষ ধ্যানীমল খন্না। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে বস্ত্র আমদানি দফতরের আধিকারিক ছিলেন। পলাশির যুদ্ধের পরে ধ্যানীমলের পুত্র রামদয়াল খন্না কলকাতায় চলে আসেন। তাঁর কোনও সন্তান না থাকায় কার্তিক পুজো শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে চার পুত্র লাভ করেন। পরে তাঁর চার ছেলের নামে আরও চারটি পুজো শুরু করেন তিনি। সেই থেকেই এই পরিবারে পাঁচটি কার্তিকের মূর্তি পুজো হয়ে আসছে। এই পরিবারের সঞ্জয় খন্না জানালেন, কার্তিকের মাথায় মুকুটের পরিবর্তে থাকে পাগড়ি। ঠিক যেমনটা উনিশ শতকের বাবুরা পরতেন। পুজোর কিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন সংক্রান্তি ধরে এই পুজো হয়। কার্তিকপুজোর দিন বিকেল থেকে শুরু করে পরের দিন সকাল পর্যন্ত। পুজোর আর এক ঐতিহ্য কার্তিকেয় সহস্রনাম পাঠ। তেমনই পুজোয় থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণের চালের নৈবেদ্য, ভোগ হিসেবে লুচি তরকারি ইত্যাদি।

তবে শুধু কলকাতাতেই নয় কার্তিক পুজোর ঐতিহ্য দেখা যায় হুগলি জেলার চুঁচুড়া, বাঁশবেড়িয়া এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়ায়।


কাটোয়ার একটি মণ্ডপের কার্তিক।

কাটোয়ার নুন পট্টিতে ‘সাতভাই’ ক্লাবের কার্তিক পুজো ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। এখানে দেখা যায় কার্তিকের রাজবেশ। সঙ্গে দেখা যায় তাঁর ছয় পারিষদ। তেমনই হরিসভা পাড়ার ২০০ বছরের বেশি পুরনো ন্যাংটা কার্তিক পুজো। শোনা যায় এ অঞ্চলের বারাঙ্গনারা ন্যাংটা কার্তিক পুজো শুরু করেছিলেন। এ ছাড়াও কাটোয়ায় অসংখ্য কার্তিকপুজো হয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য থাক কার্তিক। থাক আসলে সিঁড়ির ধাপের মতো। তার উপর চার, পাঁচ থেকে শুরু করে সাত, আট থাকের উপর পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে বিভিন্ন মূর্তি তৈরি করা হয়। এক একটি সর্বজনীন পুজোর থিম এক এক রকম। তবে আজও কাটোয়ার সর্বজনীন কার্তিকপুজোর বিশেষ আকর্ষণ কার্তিকের লড়াই। সেটা হল, এই সর্বজনীন কার্তিকের মূর্তিগুলি নিয়ে পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় সুসজ্জিত শোভাযাত্রা বের হয়। মূর্তিগুলি মণ্ডপেও বসানো থাকে লোহার চার চাকার গাড়ির উপর। আর এই গাড়ি নিয়ে বেরোয় শোভাযাত্রা। তবে কাটোয়ায় দেখা যায় নানা ধরনের কার্তিকের মূর্তি। যেমন লড়াই কার্তিক (যোদ্ধার বেশে), বাবুকার্তিক, নবানে কার্তিক, জামাইকার্তিক, খোকাকার্তিক, অর্জুনকার্তিক, শিবকার্তিক, গনেশকার্তিক, এবং কাত্যায়নীর কোলে ন্যাংটা কার্তিক উল্লেখযোগ্য।

তেমনই বাঁশবেড়িয়া এবং চঁুচুড়ার কার্তিক পুজো বিশেষ ঐতিহ্যশালী। এখানেও কার্তিকের মূর্তি নানা বৈচিত্রে ভরা। বেশিরভাগ পুজোয় কার্তিকের সঙ্গে দেখা যায় অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি। গবেষকদের মতে, এক সময় ব্রাত্যজনের পুজো বলে গণ্য হত বলে কার্তিকের সঙ্গে অন্যান্য মূর্তির প্রচলন ঘটেছিল এখানে। তবে শুধুমাত্র সন্তান কামনায় কিংবা বারাঙ্গনা সমাজের প্রভাবেই নয়, নদীর তীরবর্তী এই সব অঞ্চলে কার্তিকপুজোর ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল বাণিজ্যিক কারণে।

আজও মানুষের সরল বিশ্বাস, লৌকিক আচার আর পৌরাণিক কাহিনি এর মাঝেই উজ্জ্বল বাংলার কার্তিক আরাধনা।

—ফাইল চিত্র।

kartik puja bibhutisundar bhattacharya bibhuti sundar bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy