ট্রেনের সফর নিত্যদিনের মতোই হওয়ার কথা ছিল। তা অবশ্য হয়নি পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসের ৪৫০ জন যাত্রীর। পেহরো কুনরি স্টেশন পার হতেই রেললাইনে বিস্ফোরণ। গুলি ছুড়তে ছুড়তে ট্রেনের দখল নেয় জঙ্গিবাহিনী বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। তার পর থেকে প্রতিটা পল তাঁদের কেটেছে অসহায় এক আতঙ্কে।
যাঁরা প্রথমেই ছাড়া পেয়েছিলেন, তাঁদের চোখে বার বার ফিরে আসছে পণবন্দিদের অসহায় মুখ। যাঁরা বন্দি ছিলেন, সফল সেনা অভিযানে মুক্তি পেলেও তাঁরা ভুলতে পারছেন না নিহত ২১ জনের মৃত্যুর খতিয়ান। এমনই এক যাত্রী মুহাম্মদ নাভিদ। তাঁর কথায়, “জঙ্গিরা আমাদের ট্রেন থেকে নেমে আসতে বলল। ওরা বলেছিল কারও কোনও ক্ষতি করবে না। অথচ নামার সঙ্গে সঙ্গে বেছে বেছে গুলি চালিয়ে খুন করতে শুরু করল।” মুক্তি পাওয়ার পরেও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কেঁপে উঠছেন অনেকেই।
মাশকাফ সুড়ঙ্গের অনতিদূরের রেলপথে এখনও রয়েছে বিস্ফোরণের চিহ্ন। আশপাশের পাথরের গায়ে বুলেটের ক্ষত। জাফর এক্সপ্রেস এখন গোটা দুনিয়ার নজরে। আস্ত একটা ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনা এখনও প্রায় বিরল এই দুনিয়ায়।
ট্রেনটির দখল নিয়েছিল বালুচিস্তানের সশস্ত্র জঙ্গিবাহিনী বিএলএ-র আত্মঘাতী স্কোয়াড ‘মজিদ ব্রিগেড’। সঙ্গে ছিল ‘এসটিওএস’ ও ‘ফতেহ স্কোয়াড’। ভৌগোলিক ভাবে প্রতিকূল ওই এলাকায় দেড়দিন টানা অভিযান চালিয়ে বুধবার রাতে উদ্ধার করা হয়েছে বেশির ভাগ পণবন্দিকেই। নিকেশ করা হয়েছে জঙ্গিদলের প্রত্যেকটি সদস্যকে। জানা গিয়েছে, হামলার মূল পরিকল্পনা হয়েছিল আফগানিস্তান থেকে। তার ঠিক পরে, বৃহস্পতিবার থেকেই পাকিস্তানে এই হামলার ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা।
অভিযান শেষ হয় বুধবার রাতে। বৃহস্পতিবার উপপ্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ ইশাক ডারকে নিয়ে বালুচিস্তানে পৌঁছলেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। সঙ্গে অন্য মন্ত্রীরাও ছিলেন। বালুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী মির সরফরাজ বুগতির সঙ্গে নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। এ দিকে, বৃহস্পতিবারই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সরাসরি জানিয়ে দিলেন, “বিরোধীরা এই ঘটনায় সেনাকে কৃতিত্ব না দিয়ে সমাজমাধ্যমে ভুয়ো কথা লিখে স্রেফ ঘৃণ্য রাজনীতি করছে।” তাঁর আঙুল ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর দিকে। পিটিআই-এর শীর্ষ নেতা ওমর আয়ুব খানের পাল্টা দাবি, “আমাদের দলের সদস্যেরা পাঁচ জনও যদি একজোট হন, পুলিশের টনক নড়ে ওঠে। একটি রেললাইনে এত জন জঙ্গি জড়ো হল, সেনার কাছে কোনও খবর পৌঁছল না? অতীতে বহু বার ওই এলাকায় জঙ্গি হামলা ঘটেছে। রেলের নিরাপত্তার দিকে প্রশাসনের প্রকৃত নজর থাকলে বার বার এমন ঘটনা ঘটতে পারে না।” ওমরকে পাল্টা কটাক্ষ করে আসিফের দাবি, “যাঁরা আমাদের কটাক্ষ করছেন, তাঁদের পূর্বসূরিরা পাকিস্তানের সংবিধানকে ধ্বংস করেছেন। পিটিআই-এর নেতারা যখন কথা বলেন, আমার চিন্তা হয়। কারণ, তাঁরা তাঁদের স্মৃতি থেকে ইতিহাস মুছে ফেলেছেন!” সম্প্রতি শাহবাজ় শরিফ সরকারের বালুচিস্তান নীতির সমালোচনা করেছিলেন পিটিআইয়ের সহযোগী মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল-এর প্রধান মৌলানা ফজ়ল-উর-রহমান। সেই সময়ে যে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল, জাফর এক্সপ্রেসের ঘটনা তাতে নয়া ইন্ধন যোগ করল।
সমাজমাধ্যমেও এই নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে কার্যত দুই ভাগ হয়ে গিয়েছেন নেট-নাগরিকেরা। এক দলের দাবি, বালুচিস্তান আসলে পাকিস্তানের অংশই নয়। আর এক দল তা মানতে নারাজ। ইতিমধ্যে বিএলএ-র নাম করে সমাজমাধ্যমে এক রাইফেলধারীর ভিডিয়ো ছড়িয়েছে। আশেপাশে সশস্ত্র লোকেদের নিয়ে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ওই ব্যক্তি চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে উদ্দেশ করে বলেছে, “এখনও সময় রয়েছে, বালুচিস্তান ছেড়ে চলে যাও। না হলে এ রকম বহু হামলা হবে।” চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণ ঘিরে পাক প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাত বেড়েছে জঙ্গিদের। তাদের দাবি, বালুচিস্তানের উপরে অধিকার স্রেফ ভূমিপুত্রদের। পাকিস্তান ও চিন মিলে তাঁদের জন্মভূমি থেকে খনিজ সম্পদ লুট করার চেষ্টা করছে।
আতঙ্ক-সফরের স্মৃতি এখনও টাটকা ট্রেনযাত্রী বাবর মাসিহ-এর। তিনি বলছিলেন, “ওরা বলেছিল, এক বারও পিছনে না তাকিয়ে দ্রুত ছুটে যদি দূরে চলে যেতে পারি, তা হলে বেঁচে যাব।” বালুচিস্তানের রুক্ষ নির্মম সেই পথের রেখা কোনও দিন আর ভুলতে পারবেন না বাবর।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)