আলোয় স্মরণ। জঙ্গি হানায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাল প্যারিসবাসী। রবিবার।
ঘুরে ফিরে তদন্তের অভিমুখ শরণার্থী যোগের দিকেই। প্যারিসে হামলাকারীদের মধ্যে শরণার্থীর ছদ্মবেশে অন্তত দু’জন গ্রিস হয়ে ফ্রান্সে ঢুকেছিল বলে এখনও পর্যন্ত তদন্তে ইঙ্গিত। হামলার পিছনে আইএসের অন্তত তিনটি দল আলাদা ভাবে সক্রিয় ছিল বলেও মনে করছেন তদন্তকারীরা। কিন্তু এরা কবে এবং কী ভাবে শহরে ঢুকেছিল, কোথা থেকেই বা অর্থের জোগান এসেছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।
স্তাদ দো ফ্রঁসের গেটের বাইরে থেকে গত কাল একটি সিরীয় পাসপোর্ট উদ্ধার করে পুলিশ। এর মালিক যে অক্টোবরে শরণার্থী সেজেই গ্রিসের লোরোস দ্বীপে ঢুকেছিল, তা নিশ্চিত করেছে গ্রিস। সার্বিয়ার সংবাদমাধ্যমের একাংশের দাবি, বাতাক্লাঁ হল থেকে যে সিরীয় পাসপোর্ট মিলেছে, তার মালিক বছর আহমেদ আলমুহামেদ (২৫)। তদন্তকারীরা অবশ্য এ নিয়ে কোনও কিছু জানাননি।
বাতাক্লাঁ থেকে পাওয়া আরও দুই সন্দেহভাজনের আঙুলের ছাপ ও তাদের একজনের সিরীয় পাসপোর্ট যাচাই করতে গ্রিসকে অনুরোধ জানায় ফ্রান্স। যার উত্তরে গ্রিস জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এই দ্বিতীয় হামলাকারীও একই ভাবে লেরোসে ঢুকেছিল। কিন্তু এই দু’টি পাসপোর্ট আসল কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। স্টেডিয়ামের বাইরে আরও দু’টি তুরস্কের পাসপোর্ট মিলেছিল, যা তদন্তে ভুয়ো প্রমাণিত হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
শরণার্থীদের ভিড়ে জঙ্গিরা ঢুকতে পারে বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তারা। প্যারিস হামলায় অন্তত এমন দু’জন জঙ্গির সূত্র মেলায় বিপাকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। এই হামলার সঙ্গে শরণার্থী সমস্যার কোনও সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল। কিন্তু তদন্ত যে অভিমুখে এগোচ্ছে, তাতে তাঁর সেই দাবি ঘিরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
চোখের জলে। রবিবার ব্লাতাকাঁ কনসার্ট হলের সামনে জঙ্গি হানায় নিহতদের স্মরণ।
হামলায় শরণার্থী যোগ উড়িয়ে দিচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়নও। তবে শরণার্থী-নীতি বদলের কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। হামলার কারণ নিয়েও চলছে চাপানউতোর। পশ্চিমী দুনিয়াকে শিক্ষা দিতেই আইএসের এই হামলা বলে মনে করছেন অনেকে। ন্যাটোর প্রধান জেন্স স্টোলটেনবার্গ অবশ্য তা মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র ধ্বংস করতেই হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। এর সঙ্গে পশ্চিম-বিরোধিতার কোনও সম্পর্ক নেই।
ধন্দ রয়েছে জঙ্গিদের সংখ্যা নিয়েও। গত কাল পর্যন্ত ফ্রান্স ৮ জনের কথা বলেছিল। আজ অবশ্য পুলিশ জানিয়েছে সংখ্যাটা ৭। অন্য একটি সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, এক জঙ্গি বাতাক্লাঁ হলে হামলার পরেই পলাতক। তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। হামলাকারীদের মধ্যে এক জন মহিলা জঙ্গি ছিল বলেও জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
অন্তত তিন জন ফরাসি নাগরিকও সেই দলে ছিল বলে এখনও পর্যন্ত তদন্তে উঠে এসেছে। বেলজিয়ামে বসবাসকারী তিন ফরাসি ভাইকে ঘিরেও জোরদার হচ্ছে তদন্ত। কারা এই ত্রয়ী? এক ভাই আবদেসলাম সালাহ-র নামে এরই মধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ফ্রান্স পুলিশ।
বাতাক্লাঁ হলে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত এক জঙ্গিকে গত কালই ফরাসি নাগরিক বলে শনাক্ত করেছিল পুলিশ। আজ তার পরিচয় মিলেছে। প্রশাসনের দাবি, নিহত ওই জঙ্গির নাম ওমর ইসমাইল মোস্তেফি (২৯)। এই সূত্রে প্যারিস থেকে ওমরের বাবা ও দাদা-সহ মোট ৬ জন আত্মীয়কে আটক করেছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, ২০০৪ থেকে ২০১০-এর মধ্যে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পুলিশি অভিযোগ থাকলেও সে যে জঙ্গি দলে নাম লিখিয়েছে, পুলিশের কাছে তেমন কোনও তথ্য ছিল না। ২০১২-র শেষে ওমর প্যারিস ছেড়ে আলজেরিয়ায় নিজের পরিবারের কাছে চলে যায় বলে
সূত্রের খবর।
হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েক জনকে আটক করেছে বেলজিয়াম পুলিশও। প্রশাসনের দাবি, গত কাল দিনভর তল্লাশির পরে মলেনবিক প্রদেশ থেকে ৭ সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে একজন শুক্রবার
রাতে জঙ্গি হামলার সময় প্যারিসেই ছিল বলে দাবি পুলিশের। বেলজিয়াম সীমান্ত পেরোনোর সময়ও তিন জন সন্দেহভাজনকে আটক করা হয় গত কাল ভোরে।
বুলভার ভলতেয়ার এলাকায় বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলের বাইরে আগেই একটি ছাই-রঙা ফোক্সভাগেন পোলো গাড়ির সন্ধান পেয়েছিলেন ফরাসি কর্তৃপক্ষ। সেই গাড়ির গায়ে বেলজিয়ামের নাম্বার-প্লেট ছিল বলে দাবি পুলিশের। এর পরেই জোরদার তদন্তে নামে বেলজিয়াম। তদন্তকারীরা জানান, এই পোলো গা়ড়িটি বেলজিয়ামে বসবাসকারী দুই ফরাসি নাগরিক ভাড়া করেছিলেন। পুলিশের দাবি, এরা সন্দেহভাজন তিন ভাইয়েরই দু’জন।
প্যারিসের পূর্ব শহরতলির মন্ত্রোই এলাকা থেকেও আজ একটি কালো গাড়ির সন্ধান মিলেছে। যার মধ্যে থেকে তিনটি কালাশনিকভ রাইফেল পাওয়া গিয়েছে। ফরাসি পুলিশের সন্দেহ, শুক্রবার পোতি কাম্বোজ ও লা কাসা নোস্ত্রা রেস্তোরাঁয় হামলা চালাতে এই গাড়িটিই ব্যবহার করেছিল বন্দুকবাজের একটি দল। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশও এই কালো গাড়ির কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এর ভিতর থেকেই পূর্ব প্যারিসের রোস্তোরাঁটি লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় জঙ্গিরা।
হামলার পরে দেশ জুড়ে আড়াই হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্যারিস ও শহরতলি এলাকায় সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি কড়া নজরদারি চলছে, দেশের সব বিমানবন্দরেও। যার জেরে অনেকটাই ব্যাহত আন্তর্জাতিক উড়ান পরিষেবা। বহু পর্যটন ও বাণিজ্যিক সংস্থা এরই মধ্যে ফ্রান্স সফর বাতিল করেছে বলে সূত্রের খবর। ভুয়ো বোমাতঙ্কের জেরে আজ প্যারিসগামী একটি বিমানকে আমস্টারডামেই খালি করে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে প্রাণপণে ছন্দে ফিরতে চাইছে প্যারিস। হামলায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৫টি দেশের নাগরিক ছিলেন বলে সূত্রের খবর। তুরস্কের জি-২০ বৈঠক শুধু নয়, বিশ্ব জুড়েই এ দিন ছিল প্যারিসে হামলার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়।
ছবি: রয়টার্স।
তুরস্কে আত্মঘাতী হানা
শনিবার সিরিয়া সীমান্ত লাগোয়া দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরে পুলিশি তল্লাশির সময় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় পাঁচ পুলিশ অফিসার জখম হন। এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গভর্নর অফিস সূত্রে খবর, ওই শহরের একটি আবাসনে জঙ্গি ডেরা সন্দেহে পুলিশ তল্লাশিতে যাওয়া মাত্র এক সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। গত ১০ অক্টোবর রাজধানী শহর আঙ্কারায় একটি শান্তি সমাবেশে আইএস জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে ১০২ জনকে হত্যা করে। শনিবারই তুরস্কের অন্য এক শহরে জি-২০ শীর্ষবৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয়টি ছিল সন্ত্রাস-দমন। এ দিন অন্য এক অভিযানে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় চার সশস্ত্র জঙ্গির।
সাত সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy