তালিবানের মুঠোবন্দি আফগানিস্তান। -ছবি টুইটারের সৌজন্যে।
বোধহয় ভোকাট্টাই হয়ে গেল আফগানিস্তান!
আকাশে কাটা ঘুড়ির মতোই এ বার আফগানিস্তান এসে পড়ল তালিবানের খপ্পরে। দু’দশক পর আবার। এমনটাই মনে করছেন বেস্টসেলার ‘দ্য কাইট রানার’ উপন্যাসের লেখক খালেদ হোসেইনি।
আমেরিকার টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএন-কে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দেওয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে খালেদ বলেছেন, “আফগানিস্তানের কপালে যে কী লেখা আছে ভবিষ্যতের জন্য তা আমার জানা নেই! তবে দেশটা যে খুব ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অন্ত্রে যেন কেউ ভীষণ আঘাত দিয়েছে, এমন দম বন্ধ করা যন্ত্রণা হচ্ছে।”
হাতে ধরা লাটাই ঘোরাতে ঘোরাতে আকাশে ওড়া ঘুড়ির দিকে চোখ রেখে দৌড়নো কাবুলের দুই দুষ্টু কিশোরকে নিয়ে লেখা অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস ‘দ্য কাইট রানার’-এর লেখক খালেদ জানিয়েছেন, আফগানিস্তানের এখনকার যা পরিস্থিতি তার জন্য যতটা দায়ী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, ততটাই দায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমেরিকা। ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত সেনাবাহিনী ঢোকার আগে পর্যন্ত মোটামুটি শান্ত, স্বাভাবিকই ছিল আফগানিস্তান। খুব স্বচ্ছল না হলেও সেখানে জীবনের একটা ছন্দ ছিল। ছিল সুর, লয়, তাল। জঙ্গিদের আতঙ্কে অন্তত সিঁটিয়ে থাকতে হত না আফগানদের। কিন্তু সোভিয়েত সেনা ঢোকার পরেই বদলে যায় সেই পরিস্থিতি। আটের দশক থেকে মাথাচাড়া দেয় তালিবরা। হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। নয়ের দশকে তারা দাপিয়ে বেড়ায় আফগানিস্তানে। ২০০১-এ আমেরিকার সেনা গিয়ে তালিবদের উৎখাত করার পর সেই পরিস্থিতি বদলায়। কিন্তু ২০ বছর পর আমেরিকা হঠাৎ আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আফগান মুলুক এখন আবার কাটা ঘুড়ির মতোই গিয়ে পড়ল নৃশংস তালিবানের খপ্পরে।
১৯৭৬ পর্যন্ত কাবুলে ছিলেন খালেদ। তার পরই মা, বাবার সঙ্গে চলে আসেন আমেরিকায়। এখন আমেরিকারই নাগরিক তিনি। কিন্তু জন্মভূমির সঙ্গে, কাবুলের মানুষজন, সেখানকার প্রতিবেশী, আফগানিস্তানের বিভিন্ন মুলুকে থাকা আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন খালেদ। রাখেন এখনও। তাঁর কথায়, “আফগানিস্তান আমার রক্তে। অন্তরে, অন্দরে। সব সময়। আমার উপন্যাসগুলিও তাই আফগানদের নিয়ে। আফগান মুলুকের জীবন নিয়ে।”
সেই জীবনকে ফের চাক্ষুষ করতে, ফেলে আসা শৈশবের দিনগুলির সঙ্গে তার রং মিলিয়ে দেখতে, কাবুল ছাড়ার ২৭ বছর পর ফের আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন খালেদ। ২০০৩ সালে। তখন তালিবান জমানা উৎপাটিত হয়েছে। আমেরিকার সেনাবাহিনী নেমে পড়েছে আফগানিস্তানে।
খালেদ জানিয়েছেন, শৈশবের দিনগুলির সঙ্গে কাবুলের রং মেলাতে গিয়ে সেই সময় তিনি দেখেছিলেন কাবুল আবার ফিরে গিয়েছে সেই প্রাণবন্ত কাবুলেই। শৈশবে যেমন দেখতেন কাফেতে বসে আছে হিপিরা, রাস্তায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে যাচ্ছেন আফগান মহিলারাও, তেমনই দেখেছিলেন ২০০৩-এর কাবুলের রাস্তাঘাটে। পাড়ায় পাড়ায় মানুষের মধ্যে ওই সময় গভীর প্রত্যয়, আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতে দেখেছিলেন খালেদ। তাঁর কথায়, “আমেরিকার সেনা আফগানিস্তানে যাওয়ার পর জীবন তরতরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল বলছি না। কিন্তু সুস্থতায় ফিরেছিল। মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন তাঁদের আর কোনও বিপদ নেই। আমেরিকা বাঁচাবে। বাঁচাবে ন্যাটো। বাঁচাবে পশ্চিমি দেশগুলির জোট। তালিবরা আর ফিরে আসবে না। ফিরে আসতে পারবে না।”
খালেদের সেই সময়ের কাবুল-অভিজ্ঞতা ভীষণই আলাদা। মনে হয়েছিল, আকাশে খোলা হাওয়ায় ওড়া ঘুড়ির মতোই জীবন আবর্তিত হচ্ছে সেখানে।
খালেদ জানিয়েছেন, আমেরিকা এ বছর আফগানিস্তান থেকে যেই সেনা সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করল, সঙ্গে সঙ্গে আফগানদের মধ্যে সূত্রপাত হয়েছিল আতঙ্কের। আকাশে ঘুড়ি কেটে যাওয়ার আশঙ্কায় তখন থেকেই দিন গুনছিলেন আফগানরা। তাঁরা ভাবতে শুরু করেছিলেন তালিবরা এসে গেল বলে!
“তবু তাঁদের ভরসা ছিল সব সেনাকে এত তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেবে না আমেরিকা। আরও কিছু দিন পাশে থাকবে ন্যাটো। কিন্তু সেটা হল না। আর এত তাড়াতাড়ি ১১ দিনের মধ্যে তালিবান গোটা আফগানিস্তান দখল করে নেবে, এটাও কেউ ভেবে উঠতে পারেননি”, বলেছেন খালেদ।
এ বার কি তালিবান উদার হবে? খালেদ তা মনে করেন না। তাঁর কথায়, “ওদের বিশ্বাস করা খুব শক্ত। ওরা যে নৃশংসতা এর আগে দেখিয়েছে, তাতে ২০ বছরেই সেটা বদলে যাবে এমন ভেবে নেওয়াটা মূর্খামি। ওরা এ বার বলেছে বটে মহিলাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড়, সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, ওরা বলেছে, সেটা করা হবে শরিয়তি আইনের মধ্যে থেকেই। ফলে তালিবানের নব উদারপন্থী সংস্করণ নিয়ে আকাশকুসুম ভেবে লাভ নেই।”
ভবিষ্যত কী তা হলে আফগানিস্তানের?
খালেদ জবাবে যা বলেছেন, তার মর্মার্থ, মাটিতে আছড়ে পড়া ছাড়া আর কোন ভবিতব্যই বা অপেক্ষা করে থাকে আকাশে কাটা ঘুড়ির জন্য?
ভোকাট্টা!!!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy