পুবে সূর্যোদয় হয় বলে জানতাম। ভোরের নরম আলো পুবের জানলা দিয়েই নতুন সকালকে এনে দেয় ঘরের ভিতর। তেমনই দেখে এসেছি বরাবর। কিন্তু আমাদের পুবের জানলাটা হঠাৎ কেমন বদলে গিয়েছে। ভোর আর দেখা দিতে চাইছে না সে প্রান্তে। ওই জানলায় চোখ গেলেই কেমন দূষিত মেঘে ঢাকা কালো আকাশ দেখছি আজকাল। দেখছি অশান্তির গনগনে আগুন। দেখছি শুধু রক্ত।
তসলিমাকে যে দিন তাঁর নিজের দেশ ছাড়তে হয়েছিল, সে দিনই বোঝা উচিত ছিল, সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। ইউরোপ পর্যন্ত ছুটে গিয়ে যে দিন খুন করে দেওয়া হয়েছিল হুমায়ুন আজাদকে, সে দিনই বোঝা উচিত ছিল, ভয়ঙ্কর এক বিষবৃক্ষ অনেকটা মাথাচাড়া দিয়েছে পূর্ববঙ্গে। মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিঞ্চিত মাটি উর্বর, তাতে সংশয় নেই বিন্দুমাত্র। কিন্তু দীর্ঘ অযত্নে, অবহেলায় বহুফসলি জমিও আগাছা আর কাঁটাঝোপে ঢাকা পড়ে। এই কথাটা আমরা বোধ হয় মনে রাখিনি।
মনে রাখিনি বলেই একের পর এক ব্লগারের ক্ষতবিক্ষত, নিষ্প্রাণ দেহ দেখতে হচ্ছিল। নাস্তিক বা মুক্তমনা শিক্ষককে, ছাত্রকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছিল। তার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে কেটে ফেলা শুরু হল-- ঝিনাইদহে, পাবনায়, নাটোরে, আরও কত কত অঞ্চলে।
সর্বশেষ সংযোজন ঢাকা। শুক্রবার গভীর রাতে বাংলাদেশের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলশন আক্রান্ত হল বন্দুকধারীদের হাতে। বর্ষণসিক্ত ঋতুর রাতে বৃষ্টিতে নয়, রক্তে ভিজল ঢাকা।
কলকাতা বা ঢাকা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের রাজধানী নয়। সব বাঙালির হৃদয়পুর এই দুই মহানগর। বাঙালির চেতনার ভরকেন্দ্র এই দুই শহর। এই পৃথিবীর যত জন মানুষের মধ্যে প্রকৃত বাঙালির চেতনা জাগ্রত, তাঁরা সবাই আজ রক্তাক্ত।
এই ভাবেই বাঙালির চেতনা রক্তাক্ত হয়েছিল তখনও, যখন কলকাতার রাজপথে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তসলিমা-বিতাড়নের দাবিতে। যে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল লেখিকাকে, ঠিক সেই নিষ্ক্রিয়তাই তাঁকে দ্বিতীয় বার বাংলা-ছাড়া করেছিল। ওই নিষ্ক্রিয়তা কাম্য ছিল না। তখনই বরং বোঝা উচিত ছিল, সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। বোঝা উচিত ছিল, এখানেও বিষবৃক্ষটা মাথাচাড়া দিচ্ছে।
পূর্ববঙ্গ যেমন বোঝেনি, পশ্চিমবঙ্গও বোঝেনি। গোটা ভারতও বোঝেনি। তাই তসলিমা আবার হুমকি পেলেন। কেরলের কোনও এক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ঘোষণা করল, দেখতে পেলেই হত্যা করা হবে তসলিমাকে। কলকাতায় হোক, দিল্লিতে হোক, তিরুঅনন্তপুরমে হোক, বা পৃথিবীর অন্য যে কোনও প্রান্তে-- সুযোগ পেলেই শেষ করে দেওয়া হবে তাঁকে।
এ বার কি বুঝতে পারছি, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ? ঢাকার দৃষ্টান্ত দেখে কি উপলব্ধি করছি, বেখেয়ালে কোন বিপজ্জনক মোড়ে পৌঁছে গিয়েছি আমরা? কোমর বাঁধতে হবে এই বেলা। নচেৎ গুলিয়ে যাবে কোনটা ঝিনাইদহ আর কোনটা ঝিন্দ, কোনটা নাটোর আর কোনটা নান্দেড়, কোনটা পাবনা আর কোনটা পম্বন। ঢাকাকে যে ভাবে দেখলাম শুক্রবার গভীর রাতে, সেই ভাবে দেখতে হতে পারে কলকাতাকে বা দিল্লিকেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy