বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস যে ‘এপ্রিল সূত্র’ দিয়েছেন, তা শেষ পর্যন্ত আদৌ টিকবে তো? বাংলাদেশ থেকে পাওয়া রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এমনটাই মনে করছে ভারত। রিপোর্টের বক্তব্য, ইউনূস এপ্রিলের কথা বলে আপাতত কিছুটা সময় খরিদ করে, নিজের অবস্থানকে পোক্ত করে নিতে চাইছেন। কোনও রকম প্রস্তাবিত সংস্কারের ধার ধারবেন না তিনি, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, এর পর দেশে যে সরকারই আসুক, ইউনূস চাইছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট হতে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক জল এতটাই ঘোলা হচ্ছে যে, তিনি বুঝতে পারছেন সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিএনপি-র সঙ্গে ইউনূসের সম্পর্ক উত্তরোত্তর খারাপ হওয়ার দিকে যাচ্ছে। তাই জামায়াতে ইসলামী, নতুন ছাত্রদল এনসিপি-র একটা বড় অংশ এবং সেনার একাংশকে কাজে লাগিয়ে, তাদের গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিয়ে সুবিধামাফিক সরকার গড়ার অভিপ্রায় তাঁর। ইউনূসের সেই প্রয়াসের সঙ্গে জামায়েতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনাও খাপে খাপে মিলে গিয়েছে বলেই মনে করছে দিল্লি।
বিএনপি-র মহসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর গত কাল প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘এপ্রিল মাস নির্বাচনের জন্য কোনও ভাবেই উপযুক্ত নয়।’’ মূলত তিনটি কারণ দেখাচ্ছেন বিএনপি নেতৃত্ব, যা বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে স্বতঃসিদ্ধ বলেই ধরা হয়। এপ্রিল কালবৈশাখীর সময়, সে দেশে যে ভাবে ঝড়বৃষ্টি হয়, তাতে কোনও উৎসবের আয়োজন করাটাই এই সময় ঝুঁকিপূর্ণ। গোটা দেশ জুড়ে কয়েক দফায় নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। তার আগের মাসে রমজানের ফলে তখন নির্বাচনী প্রচারও কার্যত অসম্ভব। সর্বোপরি, ওই সময় দেশ জুড়ে এসএসসি এবং এইচএসসি (মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের) পরীক্ষাও চলবে।
কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে নয়াদিল্লি যোগাযোগ রেখে চলেছে। এ কথাও বিএনপি বুঝতে পারছে, সরকার গড়ার জন্য এমন সুবর্ণসুযোগ পরে আর তারা না-ও পেতে পারে। আওয়ামী লীগ মাঠের বাইরে। জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপি ভাল করে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার আগে যত তাড়াতাড়ি ভোট হবে, বিএনপি-র পক্ষে সরকার গড়া সহজ হবে। বেশি দেরি হলে, অর্থাৎ এই অন্তর্বর্তী সরকারের হাত শক্ত হলে, আওয়ামী লীগের মতো তাদেরও যে ভবিতব্য একই হবে না, এমন কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কী ভাবে এগোয়, সে দিকেও সতর্ক নজর রাখছে সাউথ ব্লক। অসমর্থিত সূত্রের দাবি, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ়-জামান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় করুন বা না করুন, ওয়াকার অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে তাঁর গভীর অসন্তোষের কথা একাধিকবার ব্যক্ত করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ইউনূস যে ‘এপ্রিল সূত্র’ দিয়েছেন তা সেনাপ্রধানের দেওয়া নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমাকে (ডিসেম্বর) ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একটি মহলের বক্তব্য, বর্ষাকালের পরই সে দেশে সেনাবাহিনী পদক্ষেপ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেনা মাস তিনেকের জন্য তদারকি সরকার তৈরি করিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন করাতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
তবে এর কোনও কিছুই এখনই চূড়ান্ত হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, মনে করছে নয়াদিল্লি। এটাও নজরে রাখা হচ্ছে যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গেও দিব্যি খাপ খাইয়ে নিয়েছেন ইউনূস। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, জো বাইডেনের পতনের পরই নড়বড়ে হয়ে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। ব্যাপারটা আদৌ তেমন ঘটেনি। কারণ, ব্যবসায়িক ‘ডিল’-এ বিশ্বাসী ট্রাম্প ইউনূসের সঙ্গে রফা করেছেন আরাকান সেনাকে মদত করে মায়নমার থেকে জুন্টা সরকারকে হঠাতে। তাদের স্বার্থ, সেখানে চিনের প্রভাব কমিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের। সেই সঙ্গে এটাও মনে করা হচ্ছে, এক বিপজ্জনক স্বল্পমেয়াদী খেলা খেলছেন ইউনূস, একই সঙ্গে যুযুধান আমেরিকা ও চিনের তালে তাল মিলিয়ে। এ ক্ষেত্রে যে কোনও সময় ফাটল তৈরি হতে পারে। সে দিকেও নজর রাখছ সাউথ ব্লক।
আরও দু’টি বিষয় মাথায় রাখা হচ্ছে। প্রথমত, ওয়াকার চাইলেই বর্ষার পর একজোট হয়ে পদক্ষেপ করবে সেনা— বিষয়টি এমন না-ও হতে পারে। যদিও সেনার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁর পাশে। কিন্তু বাংলাদেশে সেনায় রয়েছে একাধিক মেরু এবং সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাব যথেষ্ট। সূত্রের খবর, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মহম্মদ ফাইজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ইউনূস সরকারের কিছু উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র কমিটির কিছু নেতার সঙ্গে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, ওয়াকার-উজ়-জামান যখন বিদেশে ছিলেন, তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে সরানোর যে প্রয়াস হয়েছিল, তার পিছনে ছিলেন রহমান। ফলে ওয়াকারের নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দ্রুত ভোট তৈরির প্রয়াস কতটা সফল হয়, সেটাও দেখার।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি-র সঙ্গে কথা চালালেও তারা শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন করলে ভারতের নিরাপত্তা, সীমান্ত পরিস্থিতি, সংখ্যালঘু নিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির যে উন্নতি হবেই, এমনটা এখনই ভাবা হচ্ছে না। কারণ, বিএনপি-র পাশে থেকে এর আগে বিস্তর হাত পুড়েছে সাউথ ব্লকের। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১-এ বিএনপি সরকার গঠন করে জামায়েতের হাত ধরে। সেই যুগে নানা সময়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্ত্র ঢুকেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শিবিরে। যদিও সেই বিএনপি-র সঙ্গে আজকের দলীয় নেতৃত্বের কিছু প্রজন্মগত তফাত হয়েছে। তবু সতর্ক থাকা বুদ্ধিমানের কাজ, মনে করছে সাউথ ব্লক।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)