চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালতে বৃহস্পতিবার সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের জামিনের আর্জির শুনানি উপলক্ষে ঢাকা থেকে এক ঝাঁক আইনজীবী শহরে এসে পৌঁছেছেন। পারিশ্রমিক ছাড়াই তাঁরা চট্টগ্রামের পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ তথা সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময়কৃষ্ণের পক্ষে সওয়াল করবেন। তবে তার পরেও শুনানি আদৌ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান চিন্ময়কৃষ্ণের চট্টগ্রামের আইনজীবীরা। কারণ, আরও বেশ কিছু আইনজীবীর মতো সন্ন্যাসীর প্রধান আইনজীবী শুভাশিস শর্মা গ্রেফতারি এড়াতে আত্মগোপনে গিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও খুনের মামলা করেছে পুলিশ। অন্য আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও কঠোর মামলা দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অনুগত আইনজীবীরা হামলা ও প্রাণহানির হুমকি দিচ্ছেন বলে দাবি। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় আইনজীবীরা আদৌ আদালতে উপস্থিত হতে পারবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। বিপক্ষের আইনজীবীরা শুনানি করতে দেবেন কি না, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
অপূর্ব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ঢাকা হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের ১১ জন আইনজীবী বুধবারেই চট্টগ্রামে পৌঁছে ওকালতনামা সংগ্রহ করেছেন। এর আগে ঢাকা থেকে গিয়ে বর্ষীয়ান আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ চিন্ময়কৃষ্ণের জামিনের শুনানি এগোনোর আর্জি জানিয়েছিলেন দায়রা আদালতে। কিন্তু তাঁর কাছে ওকালতনামা না থাকায় বিচারক সেই সওয়াল গ্রহণ করেননি। এর পরে বর্ষীয়ান এই আইনজীবী ওকালতনামা সংগ্রহ করলেও আইনজীবী সমিতি তাঁকে সওয়াল করতে দেয়নি, তিনি ওই সমিতির সদস্য নন— এই যুক্তিতে। চিন্ময়কৃষ্ণের স্থানীয় এক আইনজীবী বলছেন, “রবীন্দ্র ঘোষ আমাদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে গিয়েছেন। ওকালতনামা ছাড়া গেলেন সওয়াল করতে। পরের দিন ওকালতনামা গ্রহণের পরে তিনি ঢাকায় ফিরে গেলেন। তার পরে কলকাতায় গিয়ে তিনি নানা কথা বলছেন, যার কোনও এক্তিয়ারই তাঁর নেই। তিনি কখনও আমাদের সঙ্গে ছিলেন না, এখনও নেই।” আত্মগোপনে থাকা এই আইনজীবীর অভিযোগ, রবীন্দ্র ঘোষ চট্টগ্রামে দাঁড়িয়ে আদালতে ধাক্কাধাক্কি খাওয়ার কথা বললেও এখন কলকাতায় গিয়ে বলছেন ‘বেদম মারধর’ করা হয়েছে তাঁকে। এ সবের পরে তাঁর অভিসন্ধি নিয়েই তাঁরা সন্দিহান।
চিন্ময়কৃষ্ণকে গ্রেফতারের পরে গত মাসের ৩ তারিখে চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পেশ করা হয়েছিল। সেই দিন বিচারক তাঁকে জেলে পাঠালে চিন্ময়ের এক দল অনুগামী ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে ভাঙচুর করেন। পুলিশ বেধড়ক লাঠি চালালে বড় গণ্ডগোল বেধে যায়। বিএনপির অনুগত এক আইনজীবী আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান। বৃহস্পতিবার তার জবাবে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির হওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সনাতনী জাগরণ জোট। বৃহস্পতিবার বিবৃতি দিয়ে তারা আইনজীবী ছাড়া সনাতন সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে শুনানি দেখতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘চিন্ময়কৃষ্ণের শুনানিকে কেন্দ্র করে একটি গোষ্ঠী ঘোলা পানিতে মাছ ধরার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা আমাদের যুক্তিসঙ্গত আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চাইছে। এ বিষয়ে
সনাতনী সমাজকে সতর্ক থাকতে হবে। এই অপচেষ্টা প্রতিহত করতে আইনজীবী ছাড়া সনাতনীদের কাউকে আদালত প্রাঙ্গণে না-যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।’
চিন্ময়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছেন স্থানীয় এক বিএনপি নেতা, যাঁকে বহিষ্কার করেছে দল। সেই মামলায় সনাতনী সমাজের এই নেতাকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আইনজীবীদের দাবি এই মামলাটি একেবারেই অসার, কারণ বাংলাদেশের আইনে একমাত্র সরকারই কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে পারে, অন্য কেউ নয়। কিন্তু চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চিন্ময়কৃষ্ণকে জেল হেফাজতে পাঠিয়ে দেয়। এর পরে দায়রা আদালতে জামিনের আবেদন করা হলে আদালত কার্যত চলতেই দেয়নি বিএনপি-জামায়াত পন্থী আইনজীবী সংগঠনের সদস্যরা। খুনের হুমকি পেয়ে আদালতে হাজির হতে পারেননি চিন্ময়কৃষ্ণের আইনজীবীরা। তার পরেই ২ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়। কিন্তু সন্ন্যাসীর আইনজীবীদের আশঙ্কা, যে ভাবে চিন্ময়কৃষ্ণকে জেলে ভরে রাখা হয়েছে, ইউনূস সরকার সেই কৌশলই হয়তো বজায় রাখবে। অন্যথায় তাঁর স্থানীয় আইনজীবী, সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জনেদের হেনস্থা করতে করা মামলাগুলি পুলিশ বাতিল করে দিত। বিস্ফোরক ও খুনের মামলায় আসামি করা হয়েছে এঁদের। চিন্ময়কৃষ্ণকে জেলে খাবার দিতে যাওয়া দুই কিশোর সন্ন্যাসীকেও পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)