মন্ট্রিয়েলের ছবি পাঠিয়েছেন লেখক।
ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকের কথা। চিনে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কথা শুনেছিলাম বটে, কিন্তু ততটা সিরিয়াস ছিলাম না। কত কি-ই তো ঘটে ওখানে— এমন ভাবনায় সহকর্মীদের সঙ্গে এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতাম। আমার চৈনিক সহকর্মী একটু কেঠো হাসি হেসে চুপ করে থাকত। নিজের দেশের অভিজ্ঞতা থেকে ও হয়তো জানত, কী হতে পারে। আমরা আগুনের উত্তাপ টের পাইনি।
মার্চের শুরুতে একদিন সকালে উপরওয়ালার ইমেল পেয়ে টনক নড়ল। অধ্যাপক জানিয়েছেন, পরিস্থিতি সুবিধার নয়, হয়তো লকডাউন হবে। কিছুদিনের জন্য ইউনিভার্সিটি হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। মনে ভয় ঢুকল। আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দ্রুত হারে বেড়ে যাওয়ার আগেই খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে মজুত রাখার কথা মনে হল। দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছি। টয়লেট টিস্যু পেপার থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, এমনকি পাউরুটিও বাজারে অমিল। দোকানে ঢুকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথা জিজ্ঞেস করতেই স্টোরকিপার আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেন মনে হল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে জুতো পরে ঢুকে পড়েছি।
দোকান থেকে বোরনোর সময় দেখা হল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভারতীয় ছাত্রের সঙ্গে। একগাল দাড়ি। মনে হল গবেষণা ছাড়া অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে ওঁর বিশেষ আগ্রহ নেই। জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘‘প্রায় দু’সপ্তাহ ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকবে। হাউস পার্টি করব। অতিমারি সংক্রান্ত খবর পেয়ে মনে হল বিয়ার, বাদাম ইত্যাদি বাড়িতে রাখা প্রয়োজন।’’
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত ২৬ নার্স, ৩ চিকিৎসক, ‘সংক্রামক’ ঘোষিত হাসপাতাল
এখন পরিস্থিতি সত্যিই ভয়ের। ফাঁকা রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের গাড়ি। বাড়ির সামনে কোভিড-১৯ ক্লিনিকে অ্যাম্বুল্যান্সের আসা-যাওয়া, আক্রান্তদের লম্বা লাইন। রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, ইউনিভার্সিটি সব বন্ধ। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকানগুলো খোলা। ইউনিভার্সিটিগুলো এই সেমেস্টারের জন্য অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে। রাস্তায় তিন থেকে চার জনের জটলা হলে পুলিশ চলে আসবে। জরিমানাও দিতে হতে পারে। প্রতি শনিবার মন্ট্রিয়েলবাসী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে লিওনার্দ কোহেনের গান গায়, গির্জায় সমস্বরে ঘণ্টা বাজে। স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, ডাক্তারদের প্রতি উৎসাহ দেখানোর এ এক সামান্য প্রয়াস। সব মিলিয়ে বেশ ভয়ার্ত, যুদ্ধবিদ্ধস্ত পরিবেশ।
আরও পড়ুন: সামনে লম্বা লড়াই, করোনা নিয়ে দেশবাসীকে বার্তা প্রধানমন্ত্রীর
বহুদিন আগে ডাস্টিন হফম্যান আর রেনো রুসো অভিনীত একটি ছবি দেখেছিলাম। নাম ‘আউটব্রেক’। ছবিটি শুরু হয়েছিল একটি কথা দিয়ে— ‘‘ভাইরাসই একমাত্র মানবসভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে।’’ একজন গবেষক হিসেবে বলছি, বিশ্বাস করুন, কোনওদিন ভাবিনি এই কল্পবিজ্ঞান সত্যি হবে। মাঝে মাঝে নিজেকে চিমটি কেটে দেখি, যা হচ্ছে, সবই কি সত্যি? আমরা মানে বিজ্ঞানকর্মীরা প্রকাশিত গবেষণার উপর আস্থা রাখি। ১৬ মার্চ মেডিসিন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ অনুযায়ী এই ভাইরাস সম্ভবত কোনও ল্যাবরেটরিতে তৈরি নয়, ডারউইনের সূত্র মেনেই ও নিজের অস্তিত্ব জানিয়েছে। মনে আছে ‘জুরাসিক পার্ক’ ছবিতে জন হ্যামন্ডের সেই বিখ্য়াত উক্তি— ‘‘জীবন বাঁচার রাস্তা খুঁজে নেয়।’’ আর ইভোলিউশনের সূত্র মেনেই মানুষ ওর সঙ্গে লড়ছে। ওর জন্য আমরা অনেককে হারিয়েছি, ভবিষ্যতেও হারাব। কিন্তু যা হচ্ছে, পুরোটাই বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে। বিজ্ঞান অনেকটা মৃত্যুর মতো। কঠোর, কিন্তু সত্যি। ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কারের মেঘ তাকে যতই ঢেকে রাখুক, তার আলো আকাশকে আলোকিত করবেই।
লেখক কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবরসায়নবিদ্যার গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy