E-Paper

বাড়ির সামনে গোলাগুলি, আতঙ্কে কেঁদেই ফেললাম

শুক্রবার এখানে ইদ পালিত হল। সে জন্য তিন দিনের সংঘর্ষবিরতির চুক্তি হয়েছিল দু’শিবিরে। সারাদিন বন্ধ ছিল গুলিগোলা। আমি যেখানে থাকি, বাড়ির নীচে মসজিদ।

নাজমুল হক

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:২৯
An image representing Gun Shoot

চারশোরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। প্রতীকী ছবি।

এ দেশে সেনা-আধাসেনার লড়াইয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেল। এখনও পর্যন্ত চারশোরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। কোনও মতে বেঁচে রয়েছি। তবে এমনটা চললে কত দিন প্রাণ থাকবে, বলা মুশকিল। আশার কথা, ১২টি দেশের ৬৬ জনকে সুদান থেকে উদ্ধার করে জাহাজে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মধ্যে রয়েছেন কয়েক জন ভারতীয়ও। এ বার হয়তো আমাদের পালা! দূতাবাস অবশ্য ৩ দিন অপেক্ষা করতে বলছে।

অশান্তি শুরুর পর থেকেই খাবার ও জলের সমস্যায় নাজেহাল। বিদ্যুৎ থাকছে না দীর্ঘ সময়। সবচেয়ে সমস্যা জলের! তীব্র রোদ। ভয়ঙ্কর গরম। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ড্রাম নিয়ে গিয়ে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা। যদি কপাল ভাল থাকে তা হলে জল মিলতে পারে। নয়তো নতুন জায়গায় খোঁজ।

শুক্রবার এখানে ইদ পালিত হল। সে জন্য তিন দিনের সংঘর্ষবিরতির চুক্তি হয়েছিল দু’শিবিরে। সারাদিন বন্ধ ছিল গুলিগোলা। আমি যেখানে থাকি, বাড়ির নীচে মসজিদ। সেখানে গিয়ে নমাজ পড়েই ঘরে চলে এসেছি। শুক্রবার সন্ধের পর থেকে ফের পুরনো মেজাজে যুযুধান দুই শিবির। আমি থাকি খার্তুমের বেহরির কাছে শামবাদ সেন্টারে। এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে লড়াই চলছে। তাতেই আমরা আতঙ্কিত। শনিবার দুপুরে প্রথম বার আমার বাড়ির সামনে দীর্ঘক্ষণ গুলি চলল। এত কাছে গুলির বিকট আওয়াজে কেঁদে ফেলেছিলাম।

তীব্র অশান্তির পাশাপাশি বাজার, শপিং মল, মোবাইলের দোকান— সর্বত্র লুট চলছে। শুনছি এতে আধাসেনার মদত রয়েছে। বুধবার বাজারে গিয়েছিলাম। ফেরার সময়ে আমাদের ধরেছিল লুটেরার দল। মোবাইল নিতে চাইছিল। এমনটা যে হতে পারে আগেই আঁচ পাওয়ায় বাড়িতেই ফোন রেখে বেরিয়েছিলাম। তাই নিতে পারেনি। ছুরি ঠেকিয়েছিল। ওদের হাত ধরে কাকুতিমিনতি করে বললাম, ‘‘আমাদের ছেড়ে দাও। গরিব মানুষ। দু’পয়সা রোজগারের জন্য এ দেশে এসেছি।’’ তার পরে ছাড়ল।

সেনা শনিবার জানিয়েছে, বিদেশিদের উদ্ধারে সাহায্য করা হবে। তবে তাতে কতটা ভরসা করা যায় জানি না। শুনলাম, সুদানে আটকে পড়া ভারতীয়দের ফেরানোর জন্য শুক্রবার বৈঠক করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পরেই ভারতীয় দূতাবাস উদ্ধারকাজের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছে। এক-একটি অঞ্চলের জন্য এক-একটি গ্রুপ। গ্রুপ ধরে দূতাবাস থেকে বাস পাঠাবে। তার মাধ্যমেই ভারতীয়দের উদ্ধার করবে। কিন্তু এখানে তো গুলি চলছে। বাস পর্যন্ত পৌঁছব কী ভাবে? শনিবার সকালে দূতাবাস জানায়, ‘তৈরি থাকুন। বাস পাঠানো হবে। একটি বাসে ৫০ জন উঠতে পারবেন।’

যে জায়গায় বাস আসবে, আমার বাড়ি থেকে তার দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। এতটা রাস্তা পেরোব কী ভাবে? পথে যদি সব লুট হয়ে যায়? হোয়াটসঅ্যাপের ওই গ্রুপে দূতাবাসকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর মেলেনি। আমরা কী খাচ্ছি, দূতাবাস কোনও খোঁজ নেয়নি। এখনও পর্যন্ত উদ্ধারকাজ শুরুও করেনি। ইদে কোনও রকমে দু’টো ডাল-ভাত জুটেছে। একটু বেশি করে রান্না করেছিলাম বলে শনিবার সকাল পর্যন্ত চলেছে। ভাঁড়ারে আর খাবার নেই।

শনিবার রাতে (স্থানীয় সময় ৯টা নাগাদ) ভারতীয় দূতাবাসের তরফে ফের সতর্কবার্তা জারি করে জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব মতো প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরের সুদান বন্দরে পৌঁছতে তিন দিন সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রপুঞ্জের যে সমস্ত বাস বন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে, তার পরিণতি দেখে তবেই উদ্ধারকাজ শুরু করতে চাইছে দূতাবাস। আকাশপথে হামলা বন্ধ রাখার জন্য এখনও বিবদমান দু’শিবিরের কথা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে বিমানেই উদ্ধারকাজ শুরু হতে পারে। সে জন্য বিমানবন্দরকে বিমান চলাচলের উপযুক্ত করে তুলতে ১২ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। এই মুহূর্তে উদ্ধারকাজের সমস্ত বিকল্পই খোলা রাখছে দূতাবাস। কোনও ভাবে সুদান বন্দর কিংবা মিশরে পৌঁছতে পারলে সেখান থেকে প্রত্যেকের বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করা হবে বলে জানিয়েছে দূতাবাস।

ভারত সরকারের কাছে আবেদন, দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু হোক। দূতাবাস তিন দিন অপেক্ষার কথা বলছে। এই তিন দিনের খাবার ও জলের ব্যবস্থাটুকু অন্তত করা হোক।

যে সংস্থার কাজে সুদান এসেছি, তাদের এজেন্টের কাছে পাসপোর্ট জমা রয়েছে। তা হয়তো আর ফেরত পাব না। আমার মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাড়িতে সবাই উদ্বেগে। আদৌ দেশে ফিরতে পারব তো? প্রিয়জনের সঙ্গে কি দেখা হবে? উদ্ধারের তোড়জোড় শুরু হতে কিছুটা আশা জাগছে।

(নাজমুল সুদানে কর্মরত)

অনুলিখন: স্বর্ণাভ দেব

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Gunman Attack Shoot Sudan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy