প্রতীকী ছবি
তিন মাস আগে যখন এসেছিলাম আমেরিকায়, তখন ভাবতেই পারিনি এই সফরে কী কী হতে চলেছে। ভাবতেই পারিনি ইতিহাসকে কাছ থেকে দেখার, তার শরিক হওয়ার সুযোগ পাব আমি।
এসেছিলাম দিদির সঙ্গে দেখা করতে। ওহায়োতে। তার পর তো করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আটকে যাই। লকডাউন চলছিল। তার মধ্যেই ঘটল সেই ঘটনা, যা আমেরিকাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকেও।
আমেরিকার অন্য শহরের মতোই ওহায়োর কলম্বাসেও আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আমিও তাতে যোগ দিতে গিয়েছিলাম ক’দিন আগে। ওহায়োর স্টেট হাউস অবধি মিছিল ছিল। চারিদিকে শুনতে পাচ্ছি স্লোগান, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘নো জাস্টিস, নো পিস’। বিভাজনের বিরুদ্ধে সেই গর্জে ওঠা স্লোগান শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল, কয়েক মাস আগে তো আমিও তো এমন মিছিল দেখেছি। আমার দেশের নানা প্রান্তে। আমার ক্যাম্পাস, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও তো নাগরিকদের বিভাজনের বিরুদ্ধেই পথে নেমেছিল ছাত্রসমাজ।
ভাষা আলাদা। সমাজ আলাদা। কিন্তু এমন একটা মুহূর্তে সত্যিই নিজেকে ওখান থেকে খুব একটা দূরের বলে মনে হয়নি। বর্ণবিদ্বেষ, শ্বেতাঙ্গদের ক্ষমতা জাহির করা, কৃষ্ণাঙ্গদের উপর অত্যাচারের মতো কারণে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমছিল। যে কারণে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। বহু বছর ধরে এই ক্ষোভকে দমিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্র। কিন্তু এ বার তা ফেটে পড়েছে। সেই বিস্ফোরণের বারুদ যে কেবল কৃষ্ণাঙ্গরাই, তা নয়। আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন সবাই, যাঁরা এই দমনপীড়নের বিরুদ্ধে।
মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল অজস্র পুলিশ। তাদের হাতে বন্দুক। তাদের পিছনে সেনার সাঁজোয়া গাড়ি। তবে সে সব দেখে এক জন মানুষের মধ্যেও বিন্দুমাত্র ভয়ের চিহ্ন আমি দেখিনি। কত দূর হাঁটছি, কত ক্ষণ হাঁটছি, সে সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছিল। নানা ভাষায় পোস্টার লেখা, নানা রংয়ের পতাকা, নানা সুরে গানে ভরে ছিল মিছিল। কলম্বাসের স্টেট হাউসের সামনে যখন মিছিল দাঁড়ায়, তখন সবার মধ্যে যেন লড়ে নেওয়ার এক অদম্য বিশ্বাস, এক অদ্ভুত স্পৃহা! একটা সময় সামনে থেকে পুলিশের দল বন্দুক হাতে হেঁটে আসছিল। সে সব দেখে পিছু হটা তো দূর অস্ত্, মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সবাই। দাবি একটাই, জাতি বিভাজন মানব না। বর্ণবিদ্বেষ মানব না। এর সঙ্গে কোনও আপস নয়। বাড়ি ফেরার সময় গোটা দৃশ্যটা বারবার চোখে ভাসছিল। এখানকার মানুষের লড়াকু মানসিকতা দেখে মনে হচ্ছিল আমার দেশে রাস্তায় নামা মানুষদের কথা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আসলে কোনও দেশ হয় না। গোটা বিশ্ব জুড়ে এ ভাবেই আন্দোলন বেঁচে থাকে।
মিছিলের শেষে ওখানে একটা কার্ডবোর্ডে লিখে এসেছিলাম উনিশশো সত্তর-আশির দশকে স্পেন, লাতিন আমেরিকায় সামাজিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়কার সেই বিখ্যাত গান— El pueblo unido jamas Sera vencido— ঐক্যবদ্ধদের হারানো যায় না। অজস্র মানুষের অসংখ্য বার্তার মধ্যে দিলাম আমার বার্তাটুকু। শরিক হতে চাইলাম ইতিহাসের।
(যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy