এখনও বিষয়টা হজম করে উঠতে পারছে না ফ্রান্স। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সরকারকে দুষে চলেছে। বিশ্বের সব দেশে খবরের শিরোনামে ল্যুভর। বলা হচ্ছে, ‘শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ চুরি’। রবিবার নিখুঁত ছক কষে সমস্ত প্রহরা ভেদ করে ল্যুভর জাদুঘরে ঢুকে সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সময়ের বহুমূল্য রত্নসামগ্রী লুট করে নিয়ে গিয়েছে ডাকাতেরা। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে ঠিকই, তবে লুটহওয়া ঐতিহাসিক সম্পদ ফিরে পাওয়ার আশা একেবারেই ক্ষীণ। আজও বন্ধ রাখা হয়েছে জাদুঘর।
এ পর্যন্ত তদন্তে যা যা জানা গিয়েছে, তা হল— একটি মই-সহ ট্রাক ব্যবহার করেছিল চোরেরা। সেটি জাদুঘরের সামনে রাস্তাতেই ছিল। সেই মই বেয়ে উঠে তারা জাদুঘরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঢোকে। ল্যুভর জাদুঘরের সবচেয়ে সুসজ্জিত ঘরগুলি রয়েছে এই অংশে। জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে চোরেরা। তাদের কাছে ছিল ‘অ্যাঙ্গল গ্রাইন্ডার’ ও ‘ব্লোটর্চ’। সেই দিয়ে তারা দু’টি ‘প্রবল নিরাপত্তায় মোরা’ প্রদর্শনী শো-কেস খুলে ফেলে। তার পর ৭ মিনিটের খেল। আজও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মাত্র ৭ মিনিটে গোটা কর্মকাণ্ড সেরেছিল চোরেরা। এর পর তারা মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।
ফরাসি আইনমন্ত্রী জেরাল দার্মানাঁ স্বীকার করে নিয়েছেন, ল্যুভর জাদুঘরের নিরাপত্তা যথেষ্ট পোক্ত ছিল না। তিনি আজ ফ্রান্স ইন্টার রেডিয়ো-তে বলেন, “কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, কেন একটা জানলায় যথেষ্ট নিরাপত্তা ছিল না, কেন রাস্তার মধ্যে মই-সহ গাড়ি দাঁড়িয়েছিল... এ সব নিয়ে সত্যিই কিছু বলার নেই। আমাদের গাফিলতি ছিল।” জেরাল আরও বলেন, “ফরাসিদের সকলের এই অনুভূতিই হচ্ছে যে, তাঁদের ঘরে ডাকাতি হয়েছে।” ‘অ্যাডভেঞ্চারস ইন দ্য ল্যুভর: হাউ টু ফল ইন লাভ উইথ দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট মিউজ়িয়াম’-এর লেখিকা এলেন স্কায়োলিনো জানান, ল্যুভর প্রথমে একটি দুর্গ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। তার পরে সেটি রাজপরিবারের জন্য প্রাসাদে রূপান্তরিত হয়। তাঁর কথায়, “এই হামলা ফ্রান্সের হৃৎপিণ্ডে ছুরির কোপ। ফরাসি ইতিহাসে আঘাত।”
চুরি গিয়েছে সম্রাজ্ঞী ইউজেনির এই টিয়ারা। ছবি: রয়টার্স।
লুভ্যর থেকে চুরি যাওয়া ঐতিহাসিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে হীরে ও নীলকান্তমণি বসানো রাজপরিবারের গয়না, মুকুট, রানি মেরি-এমিলি ও রানি হর্টেন্সের নেকলেস। একটি টিয়ারা চুরি গিয়েছে, যাতে ২৪টি নীলকান্তমণি ও ১০৮৩টি হিরে ছিল। এর প্রতিটিকে আলাদা করে খোলা যায় ও ব্রোচের মতো পরা যায় বলে জানিয়েছেন ল্যুভর। কর্তৃপক্ষ। তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে পান্না বসানো কানের দুল ও হার উপহার দিয়েছিলেন বিয়েতে। চুরি গিয়েছে তা-ও। তাতে ৩২টি পান্না ও ১১৩৮টি হিরে ছিল।
এই মুকুটটি চোরেরা ফেলে পালায়। ছবি: রয়টার্স।
ফরাসি সেনেট-সদস্য নাতালি গুলে বলেন, “আমার ধারণা চুরি যাওয়া রত্নসামগ্রী ইতিমধ্যেই দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। আর পাওয়া যাবে না।” তাঁর কথায়, “রত্নগুলি আলাদা আলাদা ভাবে বিক্রি করা হবে। কালো টাকা পরিষ্কার করার ওটাই সহজতম উপায়।” নাতালির আরও সন্দেহ, এই চুরির পিছনে কোনও বড় চক্র রয়েছে। তাঁর মতোই আশাহত হয়েছেন এলেন। তিনিও বলেন, “ওই রত্নগুলিকে আলাদা আলাদা করে কালোবাজারে বিক্রি করা হবে। কেউ টেরটি পাবে না।”
‘আর্ট রিকভারি ইন্টারন্যাশনাল’-এর স্রষ্টা ক্রিস্টোফার মারিনেলো বলেন, “চোরেরা যদি দ্রুতজিনিসগুলো বিক্রি করে অর্থের সন্ধান করে, তা হলে ওরা স্রেফ মূল্যবান ধাতুগুলো গলিয়ে ফেলবে। দামি পাথরগুলোকে কেটে ফেলবে। কোনও কিছু অক্ষত রাখবে না। জিনিসগুলির ঐতিহাসিক মূল্য ওদের কাছে নেই।” মারিনেলো-র মতে, জিনিস পাওয়া যাক, না-যাক, এই ধরনের অপরাধী চক্রগুলিকে খুঁজে বার করাজরুরি। যা একবার খোয়া যায়, আর পাওয়া যায় না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)