E-Paper

বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীক ভাঙাই এখন রীতি বাংলাদেশে

বাঙালির চেতনা-সংস্কৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধ— কোনও ভাস্কর্যই রেহাই পাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের বড় অংশের মতে, উগ্রবাদী শক্তিচালিত সাম্প্রদায়িক অংশ এই কাজ করে চলেছে এবং প্রশাসন নীরব দর্শক।

অনির্বাণ দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫ ০৮:৩৪
বুলডোজ়ার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে দেওয়ালগুলি।

বুলডোজ়ার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে দেওয়ালগুলি। ছবি: সমাজমাধ্যম।

গত ৫ অগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা দিয়ে বাংলাদেশে যে ‘প্রথা’র সূচনা হয়েছিল, তা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালির চেতনা-সংস্কৃতি থেকে মুক্তিযুদ্ধ— কোনও ভাস্কর্যই রেহাই পাচ্ছে না। বাংলাদেশের বিশিষ্টজনদের বড় অংশের মতে, উগ্রবাদী শক্তিচালিত সাম্প্রদায়িক অংশ এই কাজ করে চলেছে এবং প্রশাসন নীরব দর্শক।

বাংলাদেশে ভাস্কর্য ভাঙার সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার ঢাকার বিজয় সরণিতে মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণে। গত অগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে জেলায় জেলায় ভাঙা হয়েছে মুজিব-সহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার মূর্তি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জয় বাংলা ভাস্কর্যের’ নামফলক গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একই ঘটনা রাজশাহী, বরিশাল, কুষ্টিয়াতেও। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের আওতায় নজরুলের ‘অঞ্জলি লহ মোর’ ইদের ছুটির মধ্যে ভাঙা হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য বা সাংস্কৃতিক প্রতীকের উপরে নানা সময় মৌলবাদীরা হামলা চালিয়েছে। দিন কয়েক আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে ভাস্কর্য বিভাগের নামই পাল্টে দিয়েছে। এইশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও প্রশাসন নীরব।

অতীতে হেফাজতে ইসলামের দাবি ও আন্দোলনে একাধিক বার মুজিব, ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব বা মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক ভাস্কর্য অপসারণের দাবি উঠেছে। এ বার যেন সেই দাবি বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে শাসকেরা। এই পরিস্থিতিতে বিশিষ্টজনদের বড় অংশের মত, এটা দেশীয় চেতনাকে ধ্বংস করার নিঃশব্দ প্রক্রিয়া। যখন বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘ভাস্কর্য’ শব্দ নিষিদ্ধ হয়, তখন তা ভয়াবহ বার্তা দেয়।

ঢাকার সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ভাস্কর্য বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সঙ্গে স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং শিল্পকলার বিকাশ জড়িত। এটিকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া জাতীয় চেতনাকে আঘাত করছে’। উন্নয়ন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ তারিক লিংকনের কথায়, ‘‘ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বর্ণীল বাঙালি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে দৃশ্যমান রাখা হয়েছে আমাদের স্থাপত্যশৈলী আর ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে। এই ভাস্কর্য-বিরোধী প্রবণতা গভীর রাজনৈতিক ‘কালচারালক্লিনজিং’ তথা ‘আর্কিটেকচারাল ক্লিনজিং’য়ের ইঙ্গিত দেয়। যা রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসকে, ঐতিহ্যকে মুছে ফেলতে চায়।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)-এর অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য, ‘‘আইনশৃঙ্খলা কমজোরি হয়েছে বলেই মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, মূর্তি-বিরোধী, মাজার-বিরোধীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। ভাস্কর্য ভাঙার মধ্যে দিয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি দেশে একটা নতুন বয়ান তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনা অম্লান। তাকে এত সহজে মোছা যায় না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Sculpture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy