জনসভায় বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
আরও পড়ুন: ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি, ঘরবন্দি থাকুন’, লকডাউন ঘোষণা এ বার ফ্রান্সে
১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় । এক বছরের বেশি সময় জেলে আটক রেখে তাঁকে মুক্তি দিয়ে আবারও জেল গেট থেকেই গ্রেফতার করা হয়। তিনি মুক্ত হয়েই ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২-তে আবারও গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। সে বছরেই ৪ বছরের সেনা শাসনের অবসানে ১৮ জুন মুক্তি পান মুজিব।
১৯৬৬ সালে লাহৌরে বিরোধী দলের এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন।এ বছরেই তিনি আওয়ামি লিগের সভাপতি হন। ১৯৬৮-সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মামলা দায়ের করে। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার সেনানিবাসে আটক রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধু-সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। ঢাকা সেনানিবাসে শক্ত নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের বিচার শুরু হয়। কিন্তু কোটি মানুষের আন্দোলনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু সহ সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ লাখের বেশি জমায়েতের এক সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়।
এই বছরের ১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামি লিগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি তুলে বলেন, “গণ-অসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।“ বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন: ‘চিনা ভাইরাস’ বললেন ট্রাম্প, করোনা নিয়ে দোষারোপ জারি
এর মাঝেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতাসীন হন। সুরাবর্দির মৃত্যুদিবসে আওয়ামি লিগের সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। সেদিন তিনি সরাসরি বলেন, “জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি— আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।“
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামি লিগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন পায়।
আসে বাঙালির স্বাধীনতার বছর ১৯৭১। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকার রেসকোর্স মাঠের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন– বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। এই বৈঠকে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। এদিকে ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা করে দুই প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি তোলেন।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে আগুন জ্বলে ওঠে। ৭ মার্চ রেসকোর্সে এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।“ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি যেন স্পর্শ করে তার নিজস্ব স্বাধীন ভূমিখণ্ড। “প্রত্যেকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে।“ তিনি এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য প্রস্তুতি।
পুরো বাংলদেশ চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে আলোচনার জন্য ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ারা ঢাকা ছাড়েন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে। ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা— অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সেনারা কামান, ট্যাঙ্ক নিয়ে হামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন– “This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.”
আরও পড়ুন: করোনায় দেউলিয়া হতে পারে বহু বিমান সংস্থা, হুঁশিয়ারি অস্ট্রেলীয় প্রতিষ্ঠানের
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতারে তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি সেনা ও অফিসাররা প্রস্তুত হতে শুরু করেন স্বাধীনতা লড়াইয়ের জন্য। এই রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১-১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ২৬ মার্চ তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে ঘোষণা করেন।
১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সরকারে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় এই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা ছিল অনন্য। প্রায় এক কোটি শণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে আছে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিজয়ী হয়। অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের লায়ালপুর সামরিক জেলে বঙ্গবন্ধুকে গোপন বিচারে ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, খোঁড়া হয়েছিলো সেলের পাশেই তাঁর জন্য কবর।
স্বাধীনতার পর ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানানো হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চাপ দিতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে আহ্বান জানায়।
১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার সময়ে তিনি দিল্লিতে থামেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান।
আরও পড়ুন: করোনার ছায়া মার্কিন অর্থনীতিতেও, গত তিন দশকে রেকর্ড ধস ওয়াল স্ট্রিটে