Advertisement
E-Paper

আশ্চর্য! মৈনাক কাণ্ডেও চেগে উঠেছে তুমুল জাতি আর ধর্মবিদ্বেষ

মৈনাক সরকার নামের যুবকের চারপাশে আর আটকে নেই আলোচনাটা। আলোচনা না বলে বিতণ্ডা বলাই ভাল। তুমুল গালিগালাজ, তর্ক-বিতর্ক, একে অপরকে দোষারোপ করার পালা শুরু হয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৬ ১৬:৫৭

মৈনাক সরকার নামের যুবকের চারপাশে আর আটকে নেই আলোচনাটা। আলোচনা না বলে বিতণ্ডা বলাই ভাল। তুমুল গালিগালাজ, তর্ক-বিতর্ক, একে অপরকে দোষারোপ করার পালা শুরু হয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

এক বাঙালি, তথা হিন্দু, তথা ভারতীয় আমেরিকায় গিয়ে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়েছেন। দু’জনকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন। অতএব আক্রমণ শুরু জাত-ধর্ম-ভাষার নামে। গোটা ভারতীয় সম্প্রদায়টাই জঘন্য। সব বাঙালিই খারাপ। হিন্দুরা দীর্ঘ দিন মুসলমান শাসকদের অত্যাচার সহ্য করে করে খুনি হয়ে উঠেছে। এমনই সব মন্তব্য আছড়ে পড়তে শুরু করেছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে।

মৈনাক সরকারের খুনোখুনির ঘটনা সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন নিউজ ওয়েবসাইটে চোখ রেখেছে তামাম আমেরিকা। ‘খাঁটি’ মার্কিন, অভিবাসী মার্কিন, বিদেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে থিতু হওয়া মার্কিন, গ্রিন কার্ড মার্কিন, অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া মার্কিন— সব ধরনের মানুষই চোখ রেখেছেন খবরটার দিকে। আর পাঠকের মন্তব্যের কলমে যা খুশি মন্তব্যও করে যাচ্ছেন ইচ্ছামতো। ভারতীয় এবং অ-ভারতীয়দের মধ্যে তা নিয়ে রীতিমতো লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেক মার্কিন নাগরিকের মন্তব্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথার প্রতিধ্বনি— মার্কিন নাগরিকের করের টাকায় যে সব বিশ্ববিদ্যালয় চলে, বিদেশ থেকে এরা (ভারতীয়রা) সেই সব প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসছে। আর আমাদের দেশের নাগরিকদেরই খুন করছে। এদের বার করে দেওয়া উচিত। ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়।’’ এমন নানা মন্তব্য ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

একটি ওয়েবসাইটে তর্ক শুরু হল মৈনাক সরকারের ধর্ম চিহ্নিতকরণের চেষ্টা থেকে। খুনোখুনির খবরটা পড়ে এক পাঠকের মন্তব্য, ‘‘মৈনাক এক জন মুসলিম।’’ সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা পোস্ট, ‘‘না, মৈনাক হিন্দু।’’ ২৫ ডলারের বাজিও ধরে ফেললেন তিনি। অন্য এক জনের মন্তব্য, ‘‘মৈনাক বাঙালি মুসলিম, নিশ্চিত ভাবে।’’ ততক্ষণে কারও কারও টনক নড়তে শুরু করেছে। এক জন বললেন, ‘‘মৈনাক কোন ধর্মের, তাতে কী যায় আসে?’’ সে মন্তব্য অবশ্য অনেকেই দেখেও দেখলেন না।

এক পাঠক লম্বা পোস্ট করলেন। তার সারমর্ম হল— হিন্দুরা খুনোখুনিতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদের অত্যাচার সইতে সইতে ভারতীয় হিন্দুরাও লড়তে শিখে গিয়েছে। ভারতীয়রা আর ইজরায়েলিরাই পৃথিবীতে মুসলিমদের হাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

এই মুসলিম বিদ্বেষী মন্তব্যের প্রতিবাদ এল এক হিন্দুর কাছ থেকেই। সৌরভ দুবে নামে সেই ব্যক্তি লিখলেন, মুসলিমরা ভারতের ক্ষতি করেনি। ভারতের যা ক্ষতি হয়েছে, তা ব্রিটিশরা করেছে।

আরও পড়ুন:

আমেরিকার বন্দুকবাজ বাঙালি মৈনাক সরকার

কে এই মৈনাক সরকার?

অমিল বিস্তর, কিন্তু মৈনাক মনে পড়িয়ে দিল সিদ্ধার্থকে

মৈনাককে ‘বুড়ো’ বলেই চেনে দুর্গাপুরের পাড়া

কিন্তু এই সব মন্তব্যের অর্থ কী? অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই সব মন্তব্য দেখে। মৈনাক সরকার যে খুনোখুনি করলেন, তা তো নিতান্তই ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশেরও তাই মনে হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, মানসিক ভারসাম্য টলে না গেলে এমন ঘটনা কেউ ঘটাতে পারেন না। তা হলে ভারতীয় না ইজরায়েলি, হিন্দু না মুসলিম, খুনোখুনি করতে অভ্যস্ত নাকি অভ্যস্ত নয়, এ সব প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? এক মার্কিন নাগরিকই প্রতিবাদ লিখলেন সে কথা— ‘‘যে ঘটনা ঘটেছে, তা একজন গবেষক ছাত্র এবং এক জন শিক্ষকের মধ্যে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির ফল। সামগ্রিক বাবে ভারত বা ভারতীয়দের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।’’

তবে বিতর্ক থামার নয়। কেউ হিন্দুকে গালি দিচ্ছেন, কেউ মুসলমানকে গালি দিচ্ছেন, কেউ ভারতীয়দের আমেরিকা থেকে বার করে দিতে বলছেন। পাল্টাও চলছে দেদার। কেউ মার্কিনদের গালি দিচ্ছেন, কেউ বলছেন, পশ্চিমি দুনিয়ার এই বৈভব ভারতকে লুটেই হয়েছে।

এই বিতর্কে এক ভারতীয়ের মন্তব্য নজর কেড়েছে। তিনি নিজের নাম প্রকাশ করেননি। তবে জানিয়েছেন, মৈনাকের জন্ম যেখানে, তিনিও সেখানকারই বাসিন্দা ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘মৈনাকের পদবীই বলে দিচ্ছে তিনি এক জন বাঙালি এবং হিন্দু। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, বাংলাদেশের নন, মধ্য এশিয়ারও নন।

আরও একটি বিষয় হল, ভারত কোনও সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র নয়। খুব শক্তিশালী সেনাবাহিনী (পৃথিবীতে চতুর্থ) থাকা সত্ত্বেও নিজেরা আক্রান্ত না হলে আমরা কখনও কোনও দেশের সহ্গে যুদ্ধে জড়াইনি।

প্রতি বছর ভারত থেকে হাজার হাজার মানুষ আমেরিকায় পড়তে বা কাজ করতে আসেন। তাঁদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুর সংখ্যা খুব বেশি। আমি নিজে ২০০৩ সাল থেকে আমেরিকায় রয়েছি। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে পড়েছি, এমএস এবং পিএইচডি করেছি। এই প্রথম কোনও বাঙালিকে এমন অপরাধে জড়াতে দেখলাম। বাঙালি বা ভারতীয়দের বিষয়ে এমন মন্তব্য করার আগে ভাল করে জেনে নিন। দেখতে পাবেন বাঙালি বা ভারতীয়রা অন্যদের তুলনায় অপরাধ অনেক কম করেন। একজন উন্মাদ না হলে কেউ এমন খুনোখুনি করতে পারে না। কিন্তু এর সঙ্গে জাতি বা ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি নিজের পোস্টের একেবারে শেষে লিখেছেন, ‘‘মার্কিন নাগরিকদের করের টাকায় বিদেশি পড়ুয়ারা আমেরিকায় পড়াশোনা করে বললে ভুল বলা হবে। কারণ বিদেশি ছাত্ররা যে সব গবেষণাপত্র জমা দেন, সেগুলির উপর পেটেন্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও অনেক উপার্জন করে।’’ মৈনাকের অপরাধকে যে তিনি সমর্থন করছেন না, তা স্পষ্ট করেই লিখেছেন এই ব্যক্তি। মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন। কিন্তু সব ভারতীয় বা সব বাঙালিকে খলনায়ক বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটাও করেছেন।

বেশ কিছু মার্কিন নাগরিক সমর্থনও করেছেন এই ব্যক্তিকে। এক জন লিখেছেন, ‘‘খুব সুন্দর বাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু ছুতোর বা কলের মিস্ত্রি গোছের যে সব লোক নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছে, আপনার কথা তাদের মাথার উপর দিয়ে যাবে। তাই তারা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য চালিয়েই যাবে।’’

এই মন্তব্যেও কিন্তু রয়ে গিয়েছে শ্রেণিবিদ্বেষের ছোঁয়া।

Mainak Sarkar USA UCLA Racist Debates Social Sites
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy