চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী লেখিকা নাদিন গর্ডিমার। উত্তর-উপনিবেশ যুগের অন্যতম শক্তিশালী এই সাহিত্যিকের কলমে ছিল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধ-স্বর।
গর্ডিমারের পরিবারের তরফে আজ এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, রবিবার সন্ধ্যায় জোহানেসবার্গের বাড়িতে ঘুমের মধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন লেখিকা। বয়স হয়েছিল ৯০। কিছু দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। পাশে ছিলেন তাঁর পুত্র হুগো এবং কন্যা ওরিয়েন। ১৯২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটেংয়ে জন্ম গর্ডিমারের। মাত্র ন’বছর বয়সেই ধরেছিলেন কলম। প্রথম গল্প ‘কাম এগেন টুমরো।’ তখন তাঁর বয়স ১৫। গল্পটি ছাপা হয় জোহানেসবার্গের একটি পত্রিকায়। তার পরে লিখেছেন ৩০টিরও বেশি বই। ছোটগল্প এবং উপন্যাস সিদ্ধহস্ত ছিলেন দুই ক্ষেত্রেই। তাঁর সৃষ্টিতে ঘুরে ফিরে আসত বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, নির্বাসন এবং বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গ। তাঁর চরিত্ররা কালো ও সাদা, দুই দুনিয়ারই বাসিন্দা। বর্ণবৈষম্যে টুকরো হয়ে যাওয়া সমাজে ভালবাসা, ঘৃণা এবং বন্ধুত্বের গল্প বলতেন গর্ডিমার। শ্বেতাঙ্গ লেখিকার কলমে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সেই সব গল্প সাদা-কালো পৃথিবীটা থেকে উত্তরণের দিশা খুঁজত।
১৯৭৪ সালে পান বুকার আর ১৯৯১-এ নোবেল। ১৯৯৪-এ বর্ণবৈষম্যে লড়াইয়ে ইতি টানেন দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা। সেই আন্দোলনের শরিক হয়েই গর্ডিমার যোগ দেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে। ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য লড়াই শুরু তখন থেকে। আর শুরু তাঁদের গভীর মিত্রতারও। তাই মুক্তির পরে ম্যান্ডেলা প্রথম যে ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, তিনি নাদিন গর্ডিমার। পরিবারের বিবৃতি অনুযায়ী, “দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতি, মানুষ, এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করার যে নিরন্তর চেষ্টা, তার প্রতি অসম্ভব দরদী ছিলেন গর্ডিমার।” বর্ণবৈষম্যের জমানায় নিষিদ্ধ হয় তাঁর তিনটি বই। প্রথমটি ‘এ ওয়ার্ল্ড অব স্ট্রেঞ্জার্স,’ জোহানেসবার্গে ১৯৫০-এর দশকে এক অরাজনৈতিক ব্রিটিশ নাগরিকের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বন্ধুত্বের গল্প। নিষিদ্ধ হয় ১৯৬৬-র ‘দ্য লেট বুর্জোয়া ওয়ার্ল্ড’ এবং ১৯৭৯-র ‘বার্গার্স ডটার।’ শেষ বইটিতে রয়েছে নিজের পরিচয় খুঁজে পেতে মরিয়া এক মহিলার গল্প। তাঁর বাবা কারাগারে মৃত্যুবরণ করে রাজনৈতিক নায়ক হয়ে যান। তার পরেই শুরু তাঁর লড়াই।
গর্ডিমার সরব ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেকব জুমার প্রস্তাবিত এক আইনের বিরুদ্ধে। যাতে বলা হয়, যে তথ্য সরকারের কাছে স্পর্শকাতর বলে মনে হবে, তা ছাপা যাবে না। এর বিরোধিতায় গর্ডিমার বলেন, “ফের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে, এটা ভাবা যায় না। মানুষ নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেতে কী লড়াইটাই না করেছে।”
শ্বেতাঙ্গ হয়েও গর্ডিমার নিজের ‘আফ্রিকান’ ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্বিত ছিলেন। প্রাণের শহর জোহানেসবার্গেই নিজেকে খুঁজে পেতেন। বলতেন, “অন্য শহরে কালো বন্ধুদের কাছে আমি নেহাতই এক ইউরোপীয়। শুধু এখানেই আমি এক জন আফ্রিকান। শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকান।”