Advertisement
E-Paper

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান: চলে গেলেন আশ্রয়ের মহীরুহ

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই তাঁর পরিবার প্রথমে বাংলাদেশের খুলনায় আসেন। এরপর ঢাকাতেই স্থায়ী হয় তাঁর পরিবার। একদিকে মেধা, অন্যদিকে বাঙালিত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা।

অঞ্জন রায়

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২০ ০০:২৩
আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০)

আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০)

১৯৬৭ সালে পাকিস্তানি শাসকেরা জানিয়ে দিয়েছিল- রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তানের “জাতীয় ভাবাদর্শের” সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সেই কারণ দেখিয়ে পাকিস্তানের বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার কমাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।। এই সাম্প্রদায়িক ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা, তারা নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। সেখানেই প্রতিবাদী উজ্জ্বল নামটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিভিন্ন কাগজে ছাপতে দেওয়ায় অগ্রণী ভূমিকায় থাকা সেই মানুষটিই প্রয়াত হলেন ঢাকায়।

সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার ৪টা ৫৫ মিনিটে ৮৩ বছর বয়সী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রয়াত হওয়ার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিটি প্রগতি আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। পাকিস্তানি শাসকবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণের ঘটনায় যে কয়েকটি নাম ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে লেখা আছে— তাঁদের অন্যতম অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে জন্মেছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই তাঁর পরিবার প্রথমে বাংলাদেশের খুলনায় আসেন। এরপর ঢাকাতেই স্থায়ী হয় তাঁর পরিবার। একদিকে মেধা, অন্যদিকে বাঙালিত্বের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’তে নিজের জীবন ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির বিশাল ক্যানভাসে তিনি বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রার লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাস কোনও একক ব্যক্তির জীবনের ছবি নয়— একটি সময়, একটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের শিকড় খুঁজে নেওয়ার নিরন্তর যে সংগ্রাম, তারই ইতিহাস। বাঙালির প্রতিটি প্রগতি পদক্ষেপে তিনি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যুদ্ধপরাধের বিচারে তিনি ছিলেন, ছিলেন বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে কোনও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। সেনা শাসকদের আনুকূল্য বা পদপদবির জন্য কখনওই নিজের ঋজুতাকে নমনীয় না করার কারণেই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার। কয়েক প্রজন্মের কাছে তিনি ক্রমশ ছায়া দিয়ে চলা মহীরুহ– যার ছায়ায় যেমন স্বস্তি ছিল, তেমনই ছিল দ্রোহের শিক্ষা।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—ফাইল চিত্র

আরও পড়ুন: ঢাকায় প্রয়াত সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক জগতে শোকের ছায়া

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এম এ পাস করেন। তারপরে মাত্র ২২ বছর বয়সে সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসাবে শুরু করেন কর্মজীবন, এরপরে ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশটির স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রতিটি প্রগতি আন্দোলনের সম্মুখভাগেই ছিলেন আনিসুজ্জামান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলাদেশের সংবিধান বাংলাতে অনুবাদ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বাংলা অ্যাকাডেমির বাংলা বানান রীতির অভিধান-সহ বিভিন্ন কাজে তাঁর সীমাহীন অবদান ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৯১ সালের গণ আদালতের অন্যতম অভিযোগকারী ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

আরও পড়ুন: একুশে ফেব্রুয়ারি: রক্তে অক্ষর কেনার দিন

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিল্পকলা বিষয়ের ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'যামিনী' ও মাসিকপত্র 'কালি ও কলম'-এর সম্পাদকমণ্ডলির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষা এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য অজস্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে পান বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার । শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে সম্মানিত করে। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত করেছে। ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার দেশের স্বাধীনতা পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করে।

কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠান শেষে ঘরোয়া আড্ডায় তিনি ও প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিল—নিজস্ব চিত্র

এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদকে সম্মানিত হয়েছেন। গত ২০১৮ সালের ১৯ জুনে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ঘোষণা করে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ঢাকায়। গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর স্মৃতিচারণায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “আমি ছিলাম স্যরের টিউটোরিয়াল গ্রুপের শিক্ষার্থী।” প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, “তাঁর মতো বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল।”

Bangladesh Dhaka Anisuzzaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy