Advertisement
E-Paper

স্মৃতিতে ফিরেও ও-পারের ঘরে ফিরতে বিধিই বাধা

বেজায় ধন্দে পড়ে গিয়েছেন রেজাউল ইসলাম। বিস্মরণের ও-পারে গিয়ে স্মৃতিতে ফেরা বেশি কঠিন? নাকি ও-পার বাংলা থেকে এ-পার বাংলায় ঢুকে পড়ে ঘরে ফেরা কঠিনতর?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৫ ০২:৫১
বাবা ও ছেলে। রেজাউলকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ থেকে এলেন ছেলে রাসেল। — নিজস্ব চিত্র।

বাবা ও ছেলে। রেজাউলকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ থেকে এলেন ছেলে রাসেল। — নিজস্ব চিত্র।

বেজায় ধন্দে পড়ে গিয়েছেন রেজাউল ইসলাম।

বিস্মরণের ও-পারে গিয়ে স্মৃতিতে ফেরা বেশি কঠিন? নাকি ও-পার বাংলা থেকে এ-পার বাংলায় ঢুকে পড়ে ঘরে ফেরা কঠিনতর?

এটাই ধাঁধা রেজাউলের। কেননা স্মৃতি হারিয়ে আবার স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে ঘরে ফেরাটা আর হয়ে উঠছে না আইনের ফেরে।

ঝোঁকের মাথায় ২০ মাস আগে বাংলাদেশের যশোরের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন রেজাউল। সেই থেকে কাঁটাতারের বেড়া তাঁকে বেঁধে রেখেছে এ-পারে। হাজারো কাকুতি-মিনতিতেও বাড়ি ফেরার রাস্তা খুলছে না। তাঁর ছেলে রাসেল যশোর থেকে এসে বাবাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকছেন কলকাতার এক হাসপাতালে। কিন্তু বাড়ি ফিরবেন কী ভাবে? পাসপোর্ট বা ভিসা কিছুই যে নেই তাঁর বাবার!

কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের তরফে রেজাউলকে ঘরে ফেরাতে সরকারি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দু’‌দেশের বিভিন্ন মন্ত্রকের ছাড়পত্র আদায়ের পরে ঠিক কবে যে তিনি বাড়ি রওনা হতে পারবেন, সেটা এখনও অনিশ্চিত। দুতাবাসের কর্তারা জানান, বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছেলের কান্না তাঁদের মনকেও আর্দ্র করেছে। কিন্তু তাঁরাও নিয়মের হাতে বাঁধা। তাই অপেক্ষা ছাড়া পথ নেই।

কয়েক বছর ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন যশোরের হালসা গ্রামের রেজাউল। চিকিৎসা চলছিল। আচমকাই এক দিন রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। তার পরে গত কুড়ি মাসে তাঁর আর কোনও খোঁজ মেলেনি। শেষ পর্যন্ত গত মে মাসে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালের তরফে রেজাউলের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখনই প্রথম তাঁরা জানতে পারেন, ঘরছাড়া ওই প্রৌঢ় আপাতত ভারতের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কী করে এ-পারে এলেন রেজাউল? কী ভাবে যে এলেন, সেটা ঠিকঠাক জানাতে পারেননি রেজাউল। মাঝখানের কয়েকটা মাসের স্মৃতি মুছে গিয়েছে তাঁর মন থেকে। তিনি জানিয়েছেন, এটুকু মনে আছে, একটা রেললাইনের ধারে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছেন তিনি। যা পেতেন, তা-ই খেতেন। এক দিন রেললাইন পেরোতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কা খান। তার পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

পুলিশ জানাচ্ছে, বালিগঞ্জের কাছে রেললাইনের ধারে রেজাউলকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তারাই তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। চিকিৎসা চলাকালীনই ওই প্রৌঢ়ের অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে ডাক্তারেরা বুঝতে পারেন, তাঁর মানসিক সমস্যা রয়েছে। পুলিশের মাধ্যমেই তাঁকে ভর্তি করানো হয় লুম্বিনী পার্কে। একটানা চিকিৎসায় ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন রেজাউল। ওই হাসপাতালে যে-সংগঠন রোগীদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়, তাদের কাছে নিজের সবিস্তার ঠিকানাও জানান তিনি।

যে-সংস্থা ওই হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে কাজ করে, তাদের তরফে শুক্লা দাস বড়ুয়া উদ্যোগী হয়ে যোগাযোগ শুরু করেন। খবর পৌঁছয় রেজাউলের বাড়িতে। দ্রুত এ দেশে চলে আসেন তাঁর ছেলে রাসেল। দীর্ঘদিন হন্যে হয়ে খোঁজার পরে বাবার দেখা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। কারণ বৈধ নথিপত্র ছাড়াই এ দেশে ঢুকেছিলেন তাঁর বাবা।

শুশ্রূষার পথ ধরে ফিরে এসেছে রেজাউলের স্মৃতি। কিন্তু আইনের রাস্তায় ঘরে ফেরা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে তাঁর। বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, তাঁরা সবিস্তার রিপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশের বিদেশ দফতরে পাঠিয়েছেন। ওই হাইকমিশনের এক মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রিপোর্ট যাবে। তার পরে ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আসবে এ দেশের সরকারের কাছে। সেখান থেকে নির্দেশ পাবে এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। ‘‘তার পরে ছাড়া পাবেন উনি,’’ বললেন ওই মুখপাত্র। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে? মুখপাত্র বলেন, ‘‘বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে। কারণ দু’‌টো দেশ জড়িয়ে রয়েছে এর মধ্যে। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’’

এ রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানান, বাংলাদেশ থেকে এ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মারফত নির্দেশ আসার পরে আইনি পথে তাঁরা হাসপাতাল থেকে ছুটি দেবেন রেজাউলকে। তাতে কত মাস লাগবে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না তাঁরাও।

মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে মানসিক রোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও বাড়ির লোকেরা তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান না। এ ক্ষেত্রে বাড়ির লোক নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছেন। কিন্তু চাইলেই সঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়ার উপায় নেই। নিয়মের ফাঁসে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে একটা গোটা পরিবার।’’

রাসেল বলেন, ‘‘ভোটার কার্ড থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিচয়পত্র নিয়ে এসেছি। সব দেখালাম। কিন্তু শুধু ওগুলোতে তো কাজ হবে না। দুই দেশের সরকারকে এখন যা করার করতে হবে।’’

কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে দু’বার দেখা হয়েছে রাসেলের। তাঁকে দেখে কী বলেছেন বাবা?

‘‘বাবা তো শুধু একটাই কথা বলছেন। ‘যে-করে হোক, আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। তোর মায়ের কাছে নিয়ে চল’।’’ বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে আসে রাসেলের।

soma mukhopadhyay rejaul islam jessore guy legal trouble return bangladesh rejaul islam return
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy