দিদিমণি বলছেন, ‘‘তিমরিহারু সবাই থুলো সরলে বোলা... (সবাই এক সঙ্গে জোরে বলো)।’’ রং চটা লোহার লম্বাটে টেবিল আর টানা বেঞ্চিতে এক দঙ্গল কিশোরী আর কেতাদুরস্ত রঙিন চুলের জনা কয়েক নেপালি যুবা। দিদিমণির ডাকে সাড়া দিয়ে তারা ভেঙে ভেঙে সমস্বরে বলে ওঠে, ‘‘চোং ওয়া শি দা মেয়া বিদা গুয়াচিয়া।’’ যার বাংলা তর্জমা — চিন একটি অতীব সুন্দর দেশ।
‘স্পোকন চাইনিজ়’ ক্লাস চলছে।
নেপালের প্রান্তিক মফস্সল শহর মেচিনগর। জনপদের কোল ঘেঁষে ভেসে চলেছে মেচি নদী। ও পারে পানিটাঙ্কি রেঞ্জের কলাবাড়ির জঙ্গল। শিলিগুড়ির ‘স্পর্শকাতর’ চিকেন নেক করিডর সাকুল্যে বিশ কিলোমিটার। চিনা ভাষার পা পড়েছে সেখানেও।
স্থানীয় নেপালি লব্জের সঙ্গে হিন্দি এমনকি বাংলা ভাষাতেও অনায়াস ছিল যে মেচিনগর, তারা এখন দু’ঘণ্টার ক্লাসে কথ্য-চিনা রপ্ত করায় মন দিয়েছে। মেচিনগর পুরসভার স্থানীয় কর্তা রমন সুব্বা বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে নেপাল জুড়ে চিনে ভাষার জনপ্রিয়তা হুহু করে বাড়ছে। আর স্পোকন চাইনিজের ক্লাস গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে।’’ ভারত-নেপাল সীমান্তের ছোট্ট শহর মেচিনগর তারই এক টুকরো নমুনা।
মেচিনগর পুরসভার একটি অংশে কাঁকরভিটা। এই জনপদটি বিদেশি ছাতা-টুপি থেকে ঘড়ি-ক্যামেরা কিংবা হালের ডিজিটাল দ্রব্যের বিকিকিনির জন্য পর্যটকদের বহু দিনের চেনা, চিনা ভাষায় তালিম দেওয়ার ছোট-বড় সান্ধ্য স্কুলগুলি তাকে আঁকড়েই। পাহাড়ি নেপাল আর পাহাড়তলীর উত্তরবঙ্গে ভাষার আদান প্রদান নতুন নয়। হিন্দি-বাংলা-নেপালি-ইংরাজির সেই মিশ্র ভাষা সংস্কৃতির উঠোনে এখন নিঃশব্দে পা রাখেছে চিনা বা মেন ল্যান্ডের চলতি বাক্যবন্ধ।
ভাষাবিদেরা মনে করেন— বিবিধ স্থানীয় ভাষা পরস্পরের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চলার মধ্যে দিয়েই ভাষার উৎকর্ষতা বাড়ে। কিন্তু নেপালি ভাষার সঙ্গে তো চিনা কথ্য ভাষার কোনও সাযুজ্য নেই। পড়শি দেশের আগ্রাসী ‘ভূতের’ হদিশ এখানেই দেখছেন প্রশাসন এবং সেনা কর্তারা। কর্মজীবনের সিকি ভাগ উত্তরবঙ্গে কাটিয়ে যাওয়া রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা মনে করেন, ‘‘এটা ভাষার আদানপ্রদান নয়, একে বরং চিনা কূটনীতির চাল বলাই শ্রেয়। চিনা ভাষার এই অকস্মাৎ অনুপ্রবেশ নেপালের পাহাড়ি মননে ভারতকে দূরে সরিয়ে, চিনকে ঠাঁই দেওয়ার প্রকৌশল।’’ স্থানীয় ব্যাঙডুবি সেনা ছাউনির এক কর্তা আরও সরাসরি বলছেন, ‘‘নেপালের স্থানীয় মানুষকে ভারত বিদ্বেষী করে তুলতেই চিনের এটা নয়া চেষ্টা।’’
গত কয়েক বছর ধরে নেপাল জুড়ে ‘স্পোকন চাইনিজ়’-এর তেমনই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। নেপালের সংস্কৃতি মন্ত্রকের একটি সূত্র জানাচ্ছে, রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের অন্তত ১০টি নামী বেসরকারি স্কুলে মান্দারিন (চিনের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাগুলির মধ্যে মান্দারিন সবচেয়ে পরিচিত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা) শেখা শুধু বাধ্যতামূলকই করা হয়নি, সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলিকে বিশেষ অনুদানও দেওয়া হচ্ছে চিনা সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে। তা নিয়ে আপত্তিও তুলেছে নেপাল সরকার।
ওই সূত্রের দাবি, ‘কনফুসিয়াস ক্লাসরুম’ বা চিনা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রথম পাঠ দিতে নেপালের বিভিন্ন বড় শহরের স্কুলগুলির দিকে এখন নজর পড়েছে চিনের। চিনা ভাষা শিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয় সেখান থেকেই। তারই হাত ধরে কথ্য চিনার ঢল নেমেছে নেপালের পাহাড়তলিতে। যা দেখে কপালেভাঁজ পড়েছে এ দেশের— ভাষার আড়ালে আগ্রাসনের এ এক নয়া কৌশল নয় তো!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)