Advertisement
E-Paper

আমাকে দত্তক নাও! শেষ ইচ্ছে ছিল ৮৫ বছরের হানের

বড্ড একা ছিলেন তিনি। স্ত্রী মারা গিয়েছেন। দুই ছেলের কেউই দেশে থাকেন না। তাঁদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগও রাখতে চাইতেন না তিনি। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল। তাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন, এই বুঝি তাঁকে মরতে হবে একা একা। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকতে হবে একাকী।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৮ ১৮:২৮
হান জাইচেঙ।- ফাইল চিত্র।

হান জাইচেঙ।- ফাইল চিত্র।

‘আমাকে দত্তক নেবেন কেউ? প্লিজ, দত্তক নিন কেউ আমাকে!’

বাসের জন্য যেখানে অপেক্ষা করেন যাত্রীরা, সেই শেল্টারে সেলোটেপ দিয়ে সাঁটানো কাগজে নিজে হাতে ওই কথা লিখেছিলেন চিনের হান জাইচেঙ। ৮৫ বছর বয়সে পৌঁছে।

এমন নয়, তাঁর অর্থের অভাব ছিল। কিন্তু বড়ই অভাব ছিল কোনও সঙ্গীর।

বড্ড একা ছিলেন তিনি। স্ত্রী মারা গিয়েছেন। দুই ছেলের কেউই দেশে থাকেন না। তাঁদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগও রাখতে চাইতেন না তিনি। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল। তাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন, এই বুঝি তাঁকে মরতে হবে একা একা। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকতে হবে একাকী।

সেই ভয়েই একেবারে শেষ বয়সে পৌঁছে সব সময় তাঁর কাছে কাছে থাকার, তাঁর উপর নজর রেখে চলার সঙ্গী খুঁজছিলেন। ৮৫ বছর বয়সী হান জাইচেঙ। চাইছিলেন, এই বুড়ো বয়সে কেউ তাঁকে দত্তক নিন। তাঁকে দত্তক নিক কোনও সহৃদয় পরিবার।

না, কারও বোঝা হতে চাননি হান। চাননি, তাঁর ভরণপোষণের জন্য কেউ খরচ করুন।

তাই বাস স্ট্যান্ডে সাঁটানো কাগজে হান লিখেছিলেন, ‘‘এই আশির কোঠায় পৌঁছে বুড়ো তো হয়েই গিয়েছি, বড্ড একাও হয়ে পড়েছি। তবে আমার শরীর-স্বাস্থ্য ভালই। এখনও দোকান-বাজার করতে পারি, রাঁধতে পারি। নিজের কাজগুলি নিজেই করতে পারি। আমার কোনও বড় অসুখটসুখও নেই।তিয়ানজিনে একটা বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করতাম। এখন অবসর নিয়েছি। মাসে পেনশন পাই সাড়ে ৯০০ ডলার। কেউ যদি আমাকে দত্তক নেন...’’

যা চেয়েছিলেন, রাখঢাক না রেখেই হান তা লিখেছিলেন বাস স্ট্যান্ডে সাঁটানো সেই কাগজে।

লিখেছিলেন, ‘‘না, আমি কোনও নার্সিং হোমে যেতে চাই না। আমার আশা, কোনও সহৃদয় ব্যক্তি বা পরিবার আমাকে দত্তক নেবেন। আমাকে একটু সঙ্গ দেবেন। একটু দেখভাল করবেন আমার, যত দিন বাঁচি। আর মরে গেলে আমাকে শান্তিতে সমাহিত করবেন।’’ এত সব লিখে-টিখে শেষে তাঁর ফোন নম্বরটিও দিয়েছিলেন ওই বৃদ্ধ।

বয়সেও যে তাঁর আশার আলো একটুও ক্ষীণ হয়নি, সম্ভবত তার প্রমাণ দিতেই বাস স্ট্যান্ডে ওই কাগজ সাঁটিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন হান। ভেবেছিলেন, কেউ তা দেখে তাঁকে ফোন করবেন যেচে। বলবেন, তিনি দত্তক নিতে রাজি আছেন হানকে।

কিন্তু দিনের পর দিন কেটে যাওয়ার পরেও কেউ তাঁর খোঁজখবর নিলেন না দেখে কিছুটা যেন মুষড়েই পড়েছিলেন হান। কেউ কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, প্রতিবেশীরা দেখছেন না কেন আপনাকে? হানের জবাব ছিল, ‘‘তাঁদের ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি আছে। তাঁদের সময় কই!’’

তবু একা একাই বাইক চালিয়ে বাজারে যেতেন হান। ডিম, পাউরুটি কিনতেন। কিন্তু সে সব যে এক দিন আর করে উঠতে পারবেন না, তা টের পেতে শুরু করেছিলেন। তার ফলেই সঙ্গীর খোঁজে হন্যে হয়ে উঠেছিলেন তিনি।

বাস স্ট্যান্ডে সাঁটানো কাগজটায় কাজ হচ্ছে না দেখে সেটা তুলে নিয়ে একটা ব্যস্ত দোকানের দরজার বাইরের দিকে সাঁটাচ্ছিলেন এক দিন হান।

সেটা এক ভদ্রমহিলার চোখে পড়ে। তিনি ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে পোস্ট করে দেন। পোস্টে ওই ভদ্রমহিলা লিখে দেন, ‘‘আমার আশা, কোনও সহৃদয় ব্যক্তি এগিয়ে আসবেন ওঁর (হান) পাশে দাঁড়াতে।’’

তা দেখে ‘পিয়ার ভিডিও’ নামে একটি ওয়েবসাইট থেকে ভিডিও তুলতে গেলেন এক সাংবাদিক। খবরটা সেই ওয়েবসাইটে চলার পর একের পর এক ফোন আসতে শুরু করল হানের দেওয়া নম্বরে। টানা তিন মাস চলল সেই ফোন-পর্ব। ফোন এ রেস্তরাঁ থেকে। তারা বিনা খরচে খাবার দিতে চায় হানকে। হেবেই প্রদেশ থেকে এক সাংবাদিক ফোন করে বললেন, তিনি এসে দেখা করতে চান হানের সঙ্গে। ইন্টারভিউ নেবেন হানের। তাঁকে নিয়ে স্টোরি করবেন। ২০ বছর বয়সী এক আইনপড়ুয়ার সঙ্গে ফোনে বন্ধুত্বও হয়ে গেল হানের।

কিন্তু কেউই তাঁকে দত্তক নিতে চাইলেন না দেখে হতাশ হয়ে পড়লেন হান। তার পর ফোন বাজলেই বিরক্ত হয়ে তা কেটে দিতেন হান। কারও ফোন ধরতেন না।

১৯৩২-এ জন্ম হানের। দীর্ঘ জীবনে দেখেছিলেন জাপানের আগ্রাসন। মাও জে দঙের হাতে আধুনিক চিনের গড়ে ওঠা। কিন্তু মানুষ যে এতটাই বদলে গিয়েছেন, হান তা ভাবতেও পারেননি! নার্সিং হোমে গিয়েও থাকতে চাননি, ঘরদোর পরিষ্কার নয় বলে।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবার নিজেই ফোন করা শুরু করেন হান, এখানে ওখানে। সঙ্গীর খোঁজে। ফোন করেন ‘বেজিং লাভ ডেলিভারি হটলাইন’-এ। আত্মহত্যা করতে চান, এমন মানুষদের সুস্থ সামাজিক স্রোতে যারা ফেরান। শেষে ওই সংগঠনেই সপ্তাহে দু’বার ফোন করতেন হান।

হান শেষ ফোনটি করেছিলেন গত ১৩ মার্চ। তাঁর ২০ বছর বয়সী আইনপড়ুয়া বন্ধুটিকে। যাঁর নাম জিয়াং জিং। জিং হানকে ফোন করেছিলেন তার পরের দিন। কিন্তু পাননি। কারণ সেই দিনই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় হানকে। আর গত ১৭ মার্চ মৃত্যু হয় হানের। এর মধ্যে সেই আইনপড়ুয়া বন্ধুর বেশ কয়েকটি মিস্‌ড কল রয়ে গিয়েছে হানের ফোনে।

হান জেনে যেতে পারলেন না, ৮৫ বছর বয়সে বড্ড একা হয়ে গেলেও মৃত্যুর সময়ে তিনি সত্যি-সত্যিই একা হয়ে পড়েননি।

কেউ তাঁর খোঁজ নিয়েছিল। কিন্তু তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি!

China Han Zicheng Beijing Love Delivery হান জাইচেঙ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy