—প্রতীকী ছবি।
গতিপথের শেষ দিকে পৌঁছে নদীটা আন্তর্জাতিক হয়ে গিয়েছে। দুই বাংলাকে ভাগ করেছে ইছামতী, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিয়েছে। এই বিজয়া দশমীটা এলেই প্রতি বছর ইছমতির নামটা খুব শোনা যায়, তার আন্তর্জাতিকতা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দুই বাংলার মাঝে সীমারেখা টেনে দিয়ে নয়, সীমারেখাটা মুছে দিয়েই বিজয়ায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ইছামতী। দশমীতে পশ্চিমবঙ্গের টাকি-হাসনাবাদ আর পূর্ববঙ্গের দেবহাটা-পাঁচপোতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ইছামতীর বুকে, বিসর্জন এক মহামিলনের উৎসবে পরিণত হয়।
এ বারের বিজয়ায় কিন্তু আন্তর্জাতিক ইছামতী সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গত কয়েক মাস ধরে নাফ নদীতে নিরন্তর বিসর্জন হচ্ছে যাঁদের, ইছামতী সাঁতরে এখন নতুন বোধন খুঁজতে চাইছেন তাঁরা। এ কিন্তু কোনও মহামিলনের উৎসব নয়, এক মহানিষ্ক্রমণের আখ্যান।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে ইছামতী বইছে। আর ঠিক উল্টো দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে বইছে নাফ। সেও এক আন্তর্জাতিক নদী। পাহাড়-অরণ্য-কুয়াশা-মেঘ-অপরূপ প্রকৃতি ছুঁয়ে নাফ সীমারেখা টেনেছে বাংলাদেশ আর মায়ানমারের মধ্যে। কিন্তু পরিস্থিতিটা আর অপরূপ নেই সে প্রবাহে। নাফের পুব দিকে রাখাইন অঞ্চল— রোহিঙ্গা-ভূমি। সে ভূমি রোহিঙ্গাদের পায়ের তলা থেকে সরিয়ে নিতে তুমুল হিংসা আজ। তাই রাখাইন থেকে রোজ হাজার হাজার রোহিঙ্গার বিসর্জন ঘটছে নাফে।
নাফ পেরিয়ে রোজ রাখাইন ছেড়ে চট্টগ্রামে ঢুকছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। ছবি: রয়টার্স।
আচমকা এবং সম্পূর্ণ অকারণে হিংসা শুরু হয়নি। রোহিঙ্গা জঙ্গিদের বড়সড় নাশকতার পরেই রাখাইনে অভিযান শুরু করেছে মায়ানমারের বাহিনী। কিন্তু কে জঙ্গি, কে নিরীহ, এখন তার আর কোনও বাছবিচার নেই। বল্গাহীন হিংসায় রোজ ঘর ছাড়ছে নিরন্ন, সম্বলহীন, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী। নাফ নদী পেরিয়ে বা বঙ্গোপসাগরে ভেসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন সাড়ে চার লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা। অনেকে মালয়েশিয়ার দিকে যেতে চেয়েছেন, অনেকে ভারতে ঢুকে পড়েছেন, অনেকে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছেন। আর রাখাইনে ফিরতে চান না রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশেই থেকে যেতে চান, অথবা ভারতে আশ্রয় পেতে চান। কিন্তু ভারত সরকারের যুক্তি, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। নতুন করে আর কোনও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জন্য দরজা খোলা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। মানবস্রোত তবুও কি রোখা যাচ্ছে পুরোপুরি? রোখা যাচ্ছে না। উত্তর-পূর্ব ভারতে রোজ চুঁইয়ে চুইঁয়ে ঢুকছেন আশ্রয়প্রার্থী মানুষ। বাংলাদেশ পেরিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তেও ভিড় জমাচ্ছেন বহু রোহিঙ্গা। কেউ মালদহ হয়ে ঢুকতে চাইছেন, কেউ বনগাঁ দিয়ে, কেউ আবার ইছামতীর গা ঘেঁষে। মায়ানমার যাঁদের বিসর্জন দিয়েছে নাফের জলে, তাঁদের অনেকেরই আশা ইছামতীটা পেরিয়ে যেতে পারলে নতুন বোধন অপেক্ষায়।
বোধন এলেই বিসর্জনও অপেক্ষায় থাকে। আর বিসর্জন হলেই পরবর্তী বোধনের জন্য প্রহর গোনা শুরু হয়ে যায়। প্রতিটি বোধন, প্রতিটি বিসর্জনই আসলে জীবনের এক একটা মাইলফলক। এ বছরের বিজয়া দশমীর মাইলফলকে দাঁড়িয়ে দেশের দিকে বা গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে কিন্তু আরও অনেকগুলো মাইলফলক নজরে পড়ছে।
ভারত-জাপান মৈত্রীর নতুন যুগ শুরু হতে পারে, ইঙ্গিত দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ছবি: এএফপি।
নজরে পড়ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্পের শিলান্যাস করছেন। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে শুধু বুলেট ট্রেনে সীমাবদ্ধ না রেখে দুই প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করছেন, অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া হবে ভারত-জাপান মৈত্রীকে।
নজরে পড়ছে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ অসামান্য বাগ্মিতায় ভাষণ দিচ্ছেন। সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে তিনি প্রতিবেশী পাকিস্তানকে তীব্র আক্রমণ করছেন। একই সঙ্গে স্বাধীন হওয়া দু’টি দেশ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির ফারাকের কারণে কী ভাবে পরস্পরের চেয়ে যোজন যোজন দূরে আজ, কটাক্ষের সঙ্গে সে কথা ইসলামাবাদকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিদেশমন্ত্রী।
রাষ্ট্রপুঞ্জে সুষমা স্বরাজের ভাষণ তীব্র অস্বস্তি ডেকে এনেছে পাকিস্তানের জন্য। ছবি: এপি।
নজরে পড়ছে কোরীয় উপদ্বীপের আকাশে ঝঞ্ঝার ঘোর কালো মেঘ। ভয়ঙ্কর গণবিধ্বংসী অস্ত্রে শান দিচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন। অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনিয়ে দিচ্ছেন মাঝে-মধ্যেই। বাতাসে পরমাণু অস্ত্রবাহী মিসাইলের গর্জন। গোটা এশিয়া প্যাসিফিক জুড়ে ত্রাসের আবহ। আমেরিকা চরম হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, পরমাণু কর্মসূচি এবং যুদ্ধের প্ররোচনা বন্ধ না করলে উত্তর কোরিয়া আর খুব বেশি দিন টিকে থাকবে না বলে রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কিন্তু কোনও হুঁশিয়ারি, কোনও কূটনৈতিক প্রয়াসেই শান্তিপূর্ণ সুরাহার বিন্দুমাত্র আশার দেখা যাচ্ছে না।
উত্তর কোরিয়ার সামরিক আস্ফালনে ক্রমশ বাড়ছে যুদ্ধের আশঙ্কা। ছবি: এপি।
নজরে পড়ছে ভারত-চিন সম্পর্কের এক নতুন প্রেক্ষাপট। ডোকলামকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বেনজির টানাপড়েন চলেছে দু’দেশের মধ্যে। ভারতীয় এবং চিনা সেনা হিমালয়ের কোলে প্রায় আড়াই মাস মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকে পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। শেষে অসামান্য পরিণতমনস্কতা দেখিয়ে কূটনৈতিক পথে তথা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খুঁজে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই সমাধানের পর থেকে ভারত এবং চিন পরস্পরের সম্পর্কে মন্তব্যের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে। সন্ত্রাসবাদকে চিন প্রশ্রয় দেবে না, পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বেজিং। ভারতের স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ না হলে চিনের সঙ্গে অযথা বিবাদে জড়ানোর ইচ্ছা ভারতেরও নেই, বুঝিয়ে দিচ্ছে দিল্লি।
গৌরী লঙ্কেশ খুন হওয়ার পর যে তীব্র প্রতিবাদ দেখেছে গোটা দেশ, তা কট্টরবাদীদের চাপে ফেলতে বাধ্য। ছবি: পিটিআই।
নজরে পড়ছে আরও এক বিসর্জন। দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গীদের পথ ধরে গৌরী লঙ্কেশেরও বিসর্জন। দেশে অসহিষ্ণুতার কণ্ঠস্বর ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের যে পরম্পরা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য এ দেশে, সেই পরম্পরায় যতি টেনে দেওয়ার একটা তুমুল চেষ্টা হচ্ছে। ভারতীয়ত্বের ধারণাটার সেই বিসর্জন কিন্তু খুব সুখকর হবে না। সে রকম কোনও বিসর্জন যদি হয়, তা হলে পরবর্তী বোধনটা ঠিক কেমন হবে, আঁচ করতে ভয়ই লাগছে।
তবে এই বিজয়ায় আশান্বিত হওয়ার কারণও থাকছে। অসহিষ্ণুতা জনিত হিংসার একের পর এক দৃষ্টান্ত দেখেও কিন্তু ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে না ভারত। প্রত্যেকটি ঘটনার পরে বরং প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরটা আরও তীব্র হচ্ছে। আরও বেশি করে সংঘবদ্ধ হচ্ছে নাগরিক সমাজ। এই মূল্যবোধই বাঁচিয়ে রাখবে ভারতীয়ত্বকে, ভরসা থাকুক এই বিজয়ায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy