চলতি বছরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে— এই অবস্থানে অনড় বিএনপি। সেই বার্তা রবিবার এল দলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তথা খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের থেকে। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে হবে।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আরও একধাপ এগিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে তো চ্যালেঞ্জই ছুড়ে বসেছেন।
রবিবার বিকেলের পর থেকে বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। রাতে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না দাবি করেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারণে দেশ বড় সঙ্কটের মধ্যে। এ জন্য পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার।’ অন্য দিকে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের দাবি, আগামী বছরের ৩০ জুনের পরে এক দিনও ক্ষমতায় থাকবেন না ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে শফিকুল বলেন, ‘‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমি অপরাধী অনুভব করব। মহান সুযোগ পেয়েছি অভ্যুত্থানের কারণে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে টেনে আনা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরপর আর একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশের ভিতর ও বাইরে। যাতে আমরা এগোতে না পারি।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-র অনড় অবস্থান ইউনূসের রক্তচাপ বাড়ানোর পক্ষে যথেষ্টই। দিনভর জিয়ার দলের হুমকি-হুঁশিয়ারি শোনার পরে, রাতে ‘ভারত-বিরোধী’ তাস খেলেছেন তিনি। যা দেখিয়ে তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ দলগুলি মাঠে-ময়দানে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইউনূসের সঙ্গে শনিবার রাতের বৈঠকে বিএনপি নেতারা জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, তাঁরা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চান। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জোরের সঙ্গে একই কথা শোনা গেল দলের একেবারে শীর্ষস্তর থেকে। এ দিন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নিজের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে একটি ভিডিয়ো বার্তায় তারেক বলেছেন, ‘‘রাষ্ট্রের স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ রুখতে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সবচেয়ে বেশি জরুরি। মানুষের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার, সংসদ গঠিত হলে প্রশাসন জনতার কাছে জবাবদিহি করতে দায়বদ্ধ। তার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়, আর তা হলেই সরকারের পক্ষে ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করা সহজ হয় না।’’ কোনও রকম রাখঢাক না করেই জিয়া-পুত্র বলেছেন, ‘‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যোগ্য না অযোগ্য— সেটা বিষয় নয়। দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় একদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা এসেছে, অন্যদিকে এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তাই বিএনপি-র দাবি আগামী ডিসেম্বরের ভিতরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।’’ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সভায় বিএনপি-র গয়েশ্বর বলেন, ‘‘ক্ষমতায় থাকার জন্য ইউনূস মৌলবাদী গোষ্ঠীকে এক করে ফেলেছেন। জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে অন্যদের বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন। আমরা যদি বলি যে আগামিকাল রাস্তায় নামব, তা হলে মনে হয় তিনি ২৪ ঘণ্টাও থাকতে পারবেন না। কিন্তু আমরা চাই ইউনূস সফল হোন।’’
নির্বাচন এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এ দিন প্রথম দফার বৈঠকে ১১টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। পরে হেফাজতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-সহ ন’টি দল বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। পরে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘‘তিনি (ইউনূস) আলোচনা শুরু করেছেন এই কথা বলে যে আমরা অনেক বড় সঙ্কটের মধ্যে আছি’। এই সংকট বলতে উনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের এই পরিবর্তনকে একেবারেই স্বীকার করতে চায় না। পারলে আমাদের এক দিনে ধ্বংস করে দিতে চায় এবং সেই জন্য যা যা করবার দরকার, সব তারা করছে। এই ছিল তাঁর কথা।’’
ইউনূসের বিরুদ্ধে আক্রমণ এ দিনও জারি রেখেছেন হাসিনা। দলের মাদারিপুর জেলা শাখার নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ভাষণে তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন ইউনূস। দেশের মাটি বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকব, কোনও দিন কল্পনাও করিনি।’’ মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে ইউনূস সরকার গঠন করেছেন বলেও দাবি করেছন আওয়ামী লীগের প্রধান। দলের নেতা-কর্মীদের আরও বেশি করে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ-প্রতিবাদেরে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে হঠাৎ পাল্টে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই চলছে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন। এ দিন সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রক থেকে এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ অধ্যাদেশের খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া। ওই অধ্যাদেশকে ‘কালো আইন’ উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছেন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এ অধ্যাদেশে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য উস্কানির মতো ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্তের বিধান রয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)