যে দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর শাসন কোনও দিনই মেনে নেয়নি, সেই বাংলাদেশবাসী এখন তাকিয়ে সেনার ভূমিকার দিকে। ওপার বাংলায় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরে কেটেছে এক বছর। দোদুল্যমান রাজনৈতিক অবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ভাবে করা যাবে, সে জন্য মানুষ তাকিয়ে সেনাবাহিনীর দিকে। কিন্তু সূত্রের খবর, সেনার অভ্যন্তরে এখন চলছে হাজারো সমীকরণ, গোষ্ঠী পাল্টা-গোষ্ঠীর প্যাঁচপয়জার। বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘উত্তাল মাঝ সমুদ্রে একটি জাহাজের যে অবস্থা হয়, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবস্থা তার সঙ্গে তুলনা করলে কিছু ভুল হবে না।’’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কখনওই অস্বীকার করার নয়। যে দল ঢাকার মসনদে থেকেছে, তারাই নিজেদের লোক সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়েছে। অভিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, সেনায় নিজেদের লোক ঢুকিয়ে, বাহিনীকে তাঁদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা হয়েছে সব সময়ই। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জোট সরকার। সেই আমলে সেনাবাহিনীতে যে নিয়োগ হয়েছিল, তার বড় অংশই বিএনপি-র অনুগামী বলে মত অভিজ্ঞদের। তাঁদের যুক্তি, ওই সময় নিয়োগ হওয়া যে সব সেনা অফিসারের পদোন্নতি হয়েছিল, তাঁরা বর্তমানে কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার। এই অংশটি স্বাভাবিক ভাবেই আওয়ামী লীগ বিরোধী, তাদের আনুগত্য বিএনপি-র প্রতি। আবার ২০১০ সালের পরে সেনায় নিযুক্ত অংশটির গরিষ্ঠসংখ্যক অফিসার, যাঁরা বর্তমানে ক্যাপ্টেন, মেজর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল— আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল। সূত্রের খবর, বাংলাদেশের সেনার একাংশের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রভাব যথেষ্ট।
বাংলাদেশের একটি সূত্রের দাবি, সেনাবাহিনীর শীর্ষ স্তরে রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। ফয়জুল রহমান, কামরুল হাসানের মতো অনেক অফিসার আওয়ামী লীগকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। আবার জেনারেল মইন খান-সহ ৫-৬ জন অফিসার মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের তীব্র বিরোধী বলে খবর। সেনার অন্দরের খবর, যশোর সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল জে এম ইমদাদুল ইসলামের মতো তিন-চার জন সেনাকর্তার আনুগত্য জামায়াতের প্রতি। সম্প্রতি গোপালগঞ্জে অশান্তি দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই ইমদাদুল ইসলামকে।
সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে চলমান বিভিন্ন সমীকরণে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে। একটি সূত্রের খবর, সম্প্রতি ৫৭ জন সেনা অফিসারকে চিহ্নিত করে ইউনূস সরকার ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেনাপ্রধানই বিষয়টি আটকে দিয়েছেন। ওই সূত্রটি জানাচ্ছে, ওয়াকারের এই পদক্ষেপে সেনাবাহিনীতে বড় ধরনের গোলমালের সম্ভাবনা আপাতত ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খোঁজখবর রাখে এমন একটি সূত্রের দাবি, তিন জন প্রাক্তন সেনাকর্তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁরা হলেন ইকবাল করিম ভুঁইঞা, রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং আবদুল্লাহিল আমান আজমি। ইকবাল করিম গত জুলাই অভ্যুত্থানকে সরাসরি সমর্থন করে তখন সেনাবাহিনীকে ‘রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া’র কথা বলেছিলেন। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় যে ১৪ জনের ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছিল এই প্রাক্তন সেনা অফিসার রেজ্জাকুল হায়দারও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। গত ডিসেম্বরে ইউনূস সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়েছে। একটি সূত্র জানাচ্ছে, গত ৬ জুন থেকে ১৮ জুন চিন সফরে যান এই প্রাক্তন সেনাকর্তা। সেখানে চিন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকও। সেনাবাহিনীতে রেজ্জাকুলের তৎপরতা বাড়ছে বলেই খবর। আর এক জনের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রাক্তন আমির গোলাম আজমের বড় ছেলে আজমি। শেখ হাসিনার আমলে তাঁকে গুম করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)