ভরা সভায় বসে ভাষণ দিচ্ছিলেন। আচমকা সামনে থেকে ছুটে এল গুলি। ঠিক গলার মাঝখানে এসে লাগল। গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। গোটা আমেরিকায় সাড়া ফেলে দিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তরুণ রক্ষণশীল নেতা নিহত চার্লি কির্ক। সরকারি কোনও পদে ছিলেন না তিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে চার দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন। কির্ককে ‘মহান’, ‘কিংবদন্তি’ বলে উল্লেখ করেছেন। শুক্রবার এই খুনে প্রধান অভিযুক্ত টাইলার রবিনসনকে গ্রেফতার করেছে মার্কিন পুলিশ। কেন ৩১ বছর বয়সি কির্ককে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন ট্রাম্প? মার্কিন রাজনীতিতেই বা তাঁর ভূমিকা কী ছিল? কেনই বা তাঁকে এ ভাবে মরতে হল?
সরকারি পদে না থাকলেও সক্রিয় ভাবে রিপাবলিকান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কির্ক। আমেরিকায় তাঁর পরিচিতি ছিল ট্রাম্পের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হিসাবে। বুধবার ইউটা ভ্যালি ইউনিভার্সিটিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ভাষণ চলাকালীন দূর থেকে কোনও বন্দুকবাজ তাঁকে আক্রমণ করেন। নিখুঁত নিশানায় ফুঁড়ে যায় কির্কের গলা। সাধারণত, সরকারি কর্মচারী বা সেনার মৃত্যু হলে আমেরিকায় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার চল আছে। কিন্তু ট্রাম্প নির্দেশ দিয়েছেন, রবিবার পর্যন্ত কির্কের স্মরণে মার্কিন পতাকা অবনমিত থাকবে দেশ জুড়ে। তরুণ এই নেতাটি ট্রাম্পের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার ইঙ্গিত এই নির্দেশ থেকেই মিলছে।
আরও পড়ুন:
আমেরিকায় সাধারণ মানুষের কাছে পিস্তল রাখার আইন প্রচলিত আছে। চলতি বছরেই অন্তত ২০ হাজার আমেরিকানের মৃত্যু হয়েছে বন্দুকের গুলিতে। অনেকে এই আইনের বিরোধিতা করলেও কির্ক নিজে এই আইনের কট্টর সমর্থক ছিলেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুকে তিনি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করতেন। বলতেন, ‘‘নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য এইটুকু মূল্য চোকাতেই হবে।’’ এ ছাড়াও কির্ক ছিলেন ঘোর শ্বেতাঙ্গপন্থী। বিশ্বাস করতেন, আমেরিকায় শীঘ্রই শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন। অভিবাসনের বিরুদ্ধে ঢালাও প্রচার চালাতেন তিনি। আমেরিকার ১৯৬৪ সালের যে নাগরিক আইন বর্ণ, ধর্ম, জাতি, লিঙ্গের বৈষম্যকে অস্বীকার করতে বলে, তাকে ‘মারাত্মক ভুল’ বলে উল্লেখ করতেন কির্ক।
রক্ষণশীল যুক্তি দিয়ে কির্ক আমেরিকায় প্রথম খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন ২০১২ সালে। তার পর থেকে নানা ভাবে নানা মাধ্যমে নিজের ভাবধারা প্রচার করেছেন। মনেপ্রাণে ছিলেন রিপাবলিকান। যদিও প্রথম থেকে তিনি ট্রাম্পের সমর্থক ছিলেন না। ২৩ বছর বয়সে ২০১৬ সালে তিনি রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনের কনিষ্ঠতম বক্তার মর্যাদা পান। তখনও ট্রাম্পকে চিনতেন না। ওই বছর ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার পর কির্ক হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম সমর্থক। তাঁর মৃত্যুর পরে ট্রাম্প সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের মন চার্লির মতো ভাল করে কেউ বুঝতে পারেননি।’’
ট্রাম্পের এক প্রধান সহযোগী তথা আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। তাঁর উত্থানও এই কির্কের হাত ধরেই। ২০২২ সালে নিজের পডকাস্ট শো ‘দ্য চার্লি কির্ক শো’-তে ভান্সকে অতিথি হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবেও ভান্সের নামকে সমর্থন করেন।
কির্ক বিশ্বাস করতেন, মার্কিন সভ্যতা ভেঙে পড়তে চলেছে। হাল ধরতে হবে রক্ষণশীলদেরই। তাঁদের জেগে উঠে একটি নীতিগত কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। ট্রাম্প জমানায় এই মানসিকতাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। ট্রাম্প আমেরিকাকে আবার মহান করে তোলার যে বাণী প্রচার করেন, কির্ক তার অন্যতম প্রধান সমর্থক এবং প্রচারক। তাঁর ভাষণ অতি দক্ষিণপন্থী মানুষ তো বটেই, পুরনো ট্রাম্প সমর্থকদের মনেও আশা জাগাত। আবার যে সমস্ত মার্কিন যুবক-যুবতী কাকে ভোট দেবেন স্থির করতে পারছিলেন না, তাঁদের উদ্দেশেও জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন কির্ক। তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল রিপাবলিকান পার্টির ভোটব্যাঙ্ক আরও বেশি করে ভরে তোলা। ২০২৪ সালের নির্বাচন এবং ট্রাম্পের জয়ের নেপথ্যে কির্কের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা বিশেষজ্ঞেরাও মেনে নিচ্ছেন।