Advertisement
০২ মে ২০২৪

কেন বার বার হামলার শিকার ফ্রান্সই, জঙ্গিদের শিকড় কতটা গভীরে?

মুক্ত চিন্তার দেশ ফ্রান্স। খোলামেলা পরিবেশের দেশ ফ্রান্স। শিল্প, সাহিত্যের তীর্থ ফ্রান্স। চেনা ফ্রান্সের এই ছবিটি গত দেড় বছরে পাল্টে গিয়েছে। সন্ত্রাস আর আতঙ্ক তার সর্বক্ষণের সঙ্গী এখন।

নিস হামলার পর ফের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক ফরাসি প্রেসিডেন্টের। কিন্তু সেটুকুই কি যথেষ্ট? ছবি: রয়টার্স।

নিস হামলার পর ফের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক ফরাসি প্রেসিডেন্টের। কিন্তু সেটুকুই কি যথেষ্ট? ছবি: রয়টার্স।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৬ ১৩:০৫
Share: Save:

মুক্ত চিন্তার দেশ ফ্রান্স। খোলামেলা পরিবেশের দেশ ফ্রান্স। শিল্প, সাহিত্যের তীর্থ ফ্রান্স।

চেনা ফ্রান্সের এই ছবিটি গত দেড় বছরে পাল্টে গিয়েছে। সন্ত্রাস আর আতঙ্ক তার সর্বক্ষণের সঙ্গী এখন।

২০১৫-এর জানুয়ারিতে ব্যঙ্গচিত্রের পত্রিকা শার্লি এবদোয় হামলা দিয়ে শুরু। তার পরে নভেম্বর হামলা হয় প্যারিসে। এ দিন বৃহস্পতিবার জাতীয় দিবসে নিসে হামলা। এ দিনের হামলার পরে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলা আবারও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। জরুরি অবস্থাকে তিন মাস বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়তি সেনাকে পথে নামাচ্ছেন। এমনকী রিজার্ভে থাকা সেনাদেরও এ বার নামানো হবে বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস বিরোধী সামরিক অভিযানে ফ্রান্সের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এই পর পর হামলা কেন রুখতে পারছে না ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি? কেন নিরীহ, অসহায় নাগরিক বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রশ্ন ক্রমেই ক্ষোভে পরিণত হচ্ছে।

ক্ষোভের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা ৯/১১-র সময়ে ফিরে যেতে চাইছেন। ২০০১-এর নিউ ইয়র্কে হামলার পরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকা। সঙ্গে ছিল ব্রিটেন। ফ্রান্স সেই সময়ে এই জোটের পাশে সে ভাবে দাঁড়ায়নি। ইরাক অভিযান নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ফ্রান্সের তীব্র মতপার্থক্য হয়। তার পরে ১৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। রক্তনদী বইয়ে ইরাক থেকে জোটের সেনা ফিরে এসেছে। আফগানিস্তানেও বাহিনীর আকার হ্রাস করেছে আমেরিকা। এই দু’দেশে মার্কিন নীতি তীব্র ভাবে সমলোচিত হয়েছে। আজকের ইসলামিক স্টেট এই নীতির ফসল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ। কিন্তু এই সময়ে নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সাজিয়ে নিয়েছে আমেরিকা। নানা নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি, ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ, গোপনে তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও আমেরিকা যে জঙ্গি হানা সম্পর্কে অনেক বেশি সজাগ তা মেনে নেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সজাগ হয়নি ফ্রান্স। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে শৈথিল্য থেকেই গিয়েছে। জেহাদিদের তাই নতুন লক্ষ্যবস্তু বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। ফ্রান্স ও বেলজিয়াম জেহাদিদের ঊর্বরভূমিতে পরিণত হয়েছে।

ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ৭.৫% মুসলিম। তিউনিশিয়া, আলজেরিয়ার মতো পিছিয়ে থাকা মুসলিম দেশ থেকে উন্নত জীবনযাত্রার খোঁজে অনেকেই ফ্রান্সে বাসা বেধেছেন। কিন্তু একটি অংশের স্বপ্ন সফল হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে বাস করলেও ইউরোপের মূল সমাজব্যবস্থা থেকে এরা বিছিন্ন থেকে গিয়েছেন। চাকরি থেকে শুরু করে নানা অর্থনৈতিক সামজিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা পিছিয়ে আছেন। এদের একাংশের মধ্যে সহজে জেহাদি মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে আইএস-এর মতো জঙ্গি সংগঠন। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই বিপুল বিস্তারের সময়ে সেই কাজ আরও সহজ হয়েছে। তা ছাড়া নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তেমন ভাবে সজাগও ছিল না ফ্রান্স। আমেরিকার নিরাপত্তা সংস্থাগুলির মতো তৎপরতা দেখা যায়নি বলে বিশেষজ্ঞদের মত। ফলে সমাজ-বিছিন্ন যুবক-যুবতীদের মধ্যে জেহাদি ধারণা কী ভাবে চাগাড় দিয়ে উঠছে তা সম্পর্কেও তথ্য ছিল না।

আরও পড়ুন: উত্সবের ভিড়ে ট্রাক নিয়ে ঝাঁপাল জঙ্গি, ফ্রান্সে হত অন্তত ৮৪

২০১৪-এ আইএস-এর আবির্ভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই প্রথম শুধু জেহাদি হামলা নয়, খলিফাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো শুরু হয়েছে। সেই আকর্ষণে ফ্রান্স থেকে সিরিয়া যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। ইউরোপ থেকে প্রায় ছ’হাজার জেহাদি সিরিয়া গিয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বড় অংশ ফ্রান্স থেকে।

প্যারিস, ব্রাসেলস বা নিসে যে ধরনের হামলা হয়েছে, স্থানীয় স্তরে সমর্থন না থাকলে এই ধরনের হামলা চালানো সম্ভব নয়। নভেম্বরে প্যারিস হামলার অন্যতম চক্রী সালাহ আবদেলসালামকে ধরতেই প্রায় ছ’মাস লেগে গিয়েছে। ব্রাসেলসের যে আস্তানা থেকে তাকে ধরা হয়েছিল, তার কয়েকটি বাড়ি পরেই আবদেলসালাম-এর মূল বাড়ি। স্থানীয় সমর্থন না থাকলে গোয়েন্দাদের এত সক্রিয়তা সত্ত্বেও এ ভাবে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তৃণমূল স্তরের সঙ্গে ফ্রান্সের নিরাপত্তা সংস্থাগুলির এই বিছিন্নতা হামলার সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শার্লি এবদোর ঘটনার পরে সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাতে ফ্রান্স যতটা তৎপরতা দেখিয়েছে, নিজের ঘরের খবর রাখতে সে ভাবে উদ্যোগী হয়নি। ফলে নভেম্বরে আবার হামলা। সেখানেও দেখা যাচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া, বিছিন্ন স্তর থেকে জেহাদিরা উঠে এসেছে। জেহাদি হওয়ার আগে ছোটখাট অপরাধে যুক্ত ছিল তারা। শার্লি এবদো নিয়ে পথে নেমেছিল ফ্রান্স। আবারও নামবে। হয়তো ইরাক, সিরিয়ায় বিমানহানা বাড়বে। কিন্তু নিজের ঘরের দিকে চোখ ফেরানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সমাজ-বিছিন্ন যুবক-যুবতীদের আবার মূলস্রোতে ফেরাতে না পারলে, সহানুভূতির সঙ্গে তাদের অভাব-অভিযোগ না জানতে পারলে, এদের মন থেকে জেহাদের ছায়া সরানো সহজ নয়। এ ধরনের হামলার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

France Nice Attack Repeated Attacks Soft Target
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE