Advertisement
১৯ মে ২০২৪
ব্রেক্সিট পরবর্তী জমানা

ভারতীয় ডাক্তারদের সুযোগ কি বাড়বে ব্রিটেনে

ব্রিটেনের সর্বনাশ, ভারতের কি পৌষ মাস? অন্তত ভারতীয় ডাক্তারদের ক্ষেত্রে? ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসকদের ব্রিটেনে আসা ও কাজ করা কমবে, আর সেই শূন্যস্থান পূরণে ভারতীয় চিকিৎসকরা বেশি সুযোগ পাবেন, কিছু দিন ধরে এমন একটা কথা অনেকেই বলছেন।

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:০০
Share: Save:

ব্রিটেনের সর্বনাশ, ভারতের কি পৌষ মাস? অন্তত ভারতীয় ডাক্তারদের ক্ষেত্রে?

ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসকদের ব্রিটেনে আসা ও কাজ করা কমবে, আর সেই শূন্যস্থান পূরণে ভারতীয় চিকিৎসকরা বেশি সুযোগ পাবেন, কিছু দিন ধরে এমন একটা কথা অনেকেই বলছেন।

আবার উল্টো মতও রয়েছে। ব্রিটেনে কর্মরত ভারতীয় ডাক্তারদের সংগঠন ‘ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ানস অব ইন্ডিয়ান অরিজিন’ (বিএপিআইও)-এর প্রেসিডেন্ট ডাক্তার রমেশ মেটা জানালেন, ব্রেক্সিট কেবল ব্রিটেনের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, যে ভারতীয় ডাক্তাররা এখানে আসতে চান, ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে তাঁরাও সঙ্কটে পড়তে পারেন।

সমস্যাটা অবশ্য আগেই শুরু হয়েছে। মেটা জানাচ্ছেন, আগে প্রতি বছর হাজারখানেক ভারতীয় ডাক্তার ব্রিটেনে আসতেন। এখন সেই সংখ্যাটা শ’দুয়েকে নেমে এসেছে। মেটার মতে, এটা ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক, কারণ এনএইচএস-এ ডাক্তারের খুব প্রয়োজন। মেটা বলেন, ‘‘ব্রেক্সিট হওয়ার পরে ব্রিটিশ সরকার টিয়ার-টু ভিসা দেওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে। এই ভিসার দৌলতে ডাক্তাররা এখানে এসে দু’বছর প্রশিক্ষণ নিয়ে ও কাজ করে দেশে ফিরতে পারতেন।’’

কিন্তু ব্রিটেনে তো ভারতীয় ডাক্তারের চাহিদা আছে? তা হলে? মেটার জবাবে, ‘‘এটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, কারণ এ দেশে ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) এই ব্যাপারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে। এক দিকে তারা আরও চিকিৎসক পাওয়ার জন্য আমাদের সহযোগিতা চাইছে। কিন্তু অন্য দিকে ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র দফতর ভিসা আটকে দিচ্ছে। একই সরকারের দু’টি বিভাগ দু’দিকে যাচ্ছে।’’

তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘দুনিয়া জুড়ে ভারতীয় ডাক্তারদের খুবই চাহিদা রয়েছে। চাইলে তাঁরা নানা দেশেই যেতে পারেন। কিন্তু তাঁরা অনেকেই ব্রিটেনে আসতে চান, এখানে প্রশিক্ষণ নিতে চান। কিন্তু এখন তাঁদের এখানে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।’’ মেটার আশা, এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলবে না। অচিরেই ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি উপায় বার করবে এবং ডাক্তারদের ব্রিটেনে আসার অনুমতি দেবে। তাঁর মনে হয়, পরের বছর থেকে আরও অনেক
বেশি সংখ্যায় ভারতীয় ডাক্তাররা ব্রিটেনে আসতে পারবেন।

এখন ব্রিটেনে ৫০,০০০ ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডাক্তার কাজ করছেন। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস পরিচালনা করে ‘হেলথ এডুকেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তারা ঘোষণা করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে এনএইচএসের জন্য ৫০০০ জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) দরকার হবে এবং ৪০০ জনকে ভারত থেকে নিযুক্ত করা হবে। তারা বলেছিল, এই বিষয়ে ভারতের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে তাদের একটি ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই হাসপাতালটি জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের প্রশিক্ষণ দেয়।

ডাক্তার মেটা জানিয়েছেন, এনএইচএস পরিচালকদের এই ঘোষণার পরেও এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারত থেকে এক জন জিপি-ও আসেননি। ‘৫০০০ জিপি’র চাহিদা রয়েছে এবং তা পূরণ করা দরকার। কিন্তু ভারতীয় ডাক্তারদের পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, তাঁরা এখানে আসবেন আর জিপি হিসেবে কাজ করতে শুরু করবেন। এখানকার ব্যবস্থা একেবারে আলাদা। বাইরে থেকে যে সব ডাক্তার আসবেন, তাঁদের এখানে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
বাইরে থেকে জিপি আমদানি করা অত সহজ নয়।

বর্তমানে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের কোনও দেশ থেকে কোনও জিপি এলে, তাঁকে ব্রিটেনে তিন বছরের একটি ট্রেনিং নিতে হয় এবং যদি সার্জেনের কাজ করতে চান, তা হলে সেই প্রশিক্ষণের পর রয়্যাল কলেজ অব জিপি’স-এর একটি পরীক্ষা দিতে হয়।

ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন কি ভারতীয় ডাক্তারদের তুলনায় অন্য দেশের ডাক্তারদের বেশি নিয়োগ করবে? এ প্রশ্নের উত্তরে মেটা বলেন, ‘‘সেটা অসম্ভব নয়। কিন্তু আসলে সমস্যাটা হল, স্বরাষ্ট্র বিভাগ অভিবাসীর সংখ্যা কমাতে চাইছে। তার মধ্যে ভারতীয় অভিবাসীরাও রয়েছেন। এতে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ক্ষতি হচ্ছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে আসা চিকিৎসকদের ভাষার সমস্যা থাকায় তাঁরা ইংল্যান্ডে ততটা জনপ্রিয় নন। তা ছাড়া, তাঁদের প্রশিক্ষণ ও কাজের পদ্ধতি অনেক সময়েই ইংল্যান্ডের চেয়ে আলাদা। অন্য দিকে, ভারত থেকে আসা ডাক্তাররা ইংরেজি ভাল বলতে পারেন এবং তাঁদের মেডিক্যাল ট্রেনিং ইংল্যান্ডের মতোই। ফলে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে ভারতীয় ডাক্তারদের চাহিদা বেশ বেশি।’’

আগামী মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে ভারত সফরে যাবেন। ভারত সরকারের তাঁর কাছে কী দাবি করা উচিত, জানতে চাইলে মেটা খোলাখুলি এবং কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, ‘‘নতুন প্রধানমন্ত্রী করছেনটা কী? তাঁর কর্তব্য হল তাঁর অধীনের দু’টো বিভাগের মধ্যে একটা সমন্বয় স্থাপন করা, যাতে তারা একসঙ্গে কাজ করে।’’

বিএপিআইও-র দশ হাজার সদস্য আছেন, সবাই ব্রিটেনে কর্মরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসক। এই সংস্থা ভারত থেকে ডাক্তারদের ব্রিটেনে নিয়ে আসে, তাঁদের প্রশিক্ষণ ও বৃত্তির ব্যবস্থা করে, বিভিন্ন হাসপাতালে কাজের সুযোগ পেতে সহযোগিতা করে, তাঁদের পরামর্শ দেয় ও অন্য নানা ভাবে সাহায্য করে।

দুই তরুণ ভারতীয় দম্পতির সঙ্গে কথা হল। দু’জনেই চিকিৎসক। তাঁরা গত অগস্টে, ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তের পরে, ব্রিটেনে এসেছেন। খুব তাড়াতাড়িই তাঁরা বিএপিআইও-র সদস্য হবেন। স্বামী নিউরোসার্জন, এনএইচএস-এর সঙ্গে যুক্ত। তিনি একটি ফেলোশিপ নিয়ে ব্রিটেনে এসেছেন। স্ত্রী সাইকায়াট্রিস্ট। তাঁর কথায়, ‘‘আমার স্বামী এখানে প্রথমে এসেছেন। তখন পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ মসৃণ ভাবেই হয়ে গিয়েছিল।’’ কিন্তু তাঁর নিজের বেলা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই মহিলা চিকিৎসক বললেন, ‘‘যখন ভিসার প্রক্রিয়াটা শুরু করি, তার কয়েক দিন পরেই ব্রেক্সিট নিয়ে শোরগোলটা চরমে ওঠে। আমার ব্রিটেনে আসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ছ’মাস লেগে যায়।’’ ‌

তবে ব্রেক্সিটের জন্যে ব্রিটিশ সহকর্মীদের আচরণে কোনও বিরূপতা দেখেননি ভারতীয় ডাক্তাররা। অনেকেই জানিয়েছেন, ভারতীয় চিকিৎসকদের সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে এ দেশে।

ব্রেক্সিটের পরে ব্রিটেনে তাঁদের কাজের সুযোগ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক ভারতীয় ডাক্তার। এক ডাক্তার বললেন, ‘‘শুনেছি, আগে ইইউ-এর চিকিৎসকদের প্রথম সুযোগ দেওয়া হতো, তার পরে অন্যদের। এখন ভারতীয়দের সামনে নতুন পথ খুলতে পারে।’’ তবে ব্রিটেনে বসবাসকারী অনেকে চিকিৎসকই জানাচ্ছেন, বিকল্প পরিকল্পনার কথাও ভাবতে শুরু করেছেন তাঁরা। কারণ ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অনিশ্চিত। পাউন্ডের দামও কমতে পারে। তাই এ দেশে আসা, বা এখানে থাকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার আগে দু’বার ভাবছেন ভারতীয় চিকিৎসকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Britain Doctors Students Brexit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE