মরিয়ম মির্জাখানি। ছবি: এএফপি
দেশে তখন সদ্য থেমেছে যুদ্ধ। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরান নয়, তাঁর কল্পনায় ঘোরাফেরা করত রূপকথার নানা চরিত্র। বই-পাগল ছোট্ট মেয়েটা স্বপ্ন দেখত, এক দিন সে বড় লেখিকা হবে। বড় সে হয়েছে। তবে তার কল্পনায় এখন কোনও নায়ক-নায়িকা নেই। বরং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হাইপারবলিক জিয়োমেট্রি বা সিমপ্লেটিক থিয়োরির মতো জটিল সব তত্ত্ব। গণিতের সে সব কঠিন রহস্য সমাধান করেই এ বছর অঙ্কের নোবেল ‘ফিল্ডস’ সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছে সে।
ইরানের মরিয়ম মির্জাখানি। ফিল্ডস সম্মান-জয়ী প্রথম মহিলা।
সে দিনের সেই বাচ্চা মেয়েটি এখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই তাঁর ঝুলিতে গণিতের সর্বোচ্চ খেতাব। গল্প-উপন্যাস আর লেখা হয়ে ওঠেনি মরিয়মের। তবে তাঁর বড় হওয়াটাই গল্পের মতো।
নিজেই বললেন সে কথা। জানালেন, আর বছর দশেক আগে জন্মালে এ সব কিছুই করা হতো না তাঁর। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে দেশের অবস্থা তখন টালমাটাল। এলিমেন্টারি স্কুলের পাঠ চুকিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হলেন যে সালে, যুদ্ধ থামল সেই বছরই। আর তার পর... তেহরানের ফারজানেগান স্কুলটা আমূল বদলে দিল মরিয়মের জীবন। যে মেয়ে কোনও দিন ভাবেননি অঙ্ক নিয়ে পড়বেন, এক সময় শিক্ষিকারা যাঁকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এ মেয়ে অঙ্কে তেমন ভাল নয়’, সেই মরিয়মই হয়ে উঠলেন সেরার সেরা।
তবে শুধু স্কুলই নয়, ইরানের মতো দেশে রক্ষণশীল সমাজে বাস করে স্বপ্ন দেখানোর পিছনে তাঁর বাবা-মায়ের কৃতিত্বও কম নয়। যদিও মরিয়মে দাবি, বহির্বিশ্বের চোখে দেশটা যেমন, ইরান ততটাও গোড়া নয়। ছেলে-মেয়েদের এক স্কুলে পড়াশোনা করা হয়তো নিষিদ্ধ, কিন্তু নারীশিক্ষায় কোনও বাধা নেই সেখানে। মরিয়মের মা-বাবা যেমন সব সময় মেয়েকে বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। অঙ্কের প্রতি তাঁর ভালবাসাটা অবশ্য তাঁকে প্রথম টের পাইয়েছিলেন দাদা। মরিয়ম জানালেন, স্কুলে গিয়ে দাদা যা যা শিখতেন, বাড়ি ফিরে সবই তাঁকে গল্প করতেন। এক দিন স্কুল থেকে ফিরে দাদা বলেছিলেন, ১ থেকে ১০০-র যোগফল বলতে। সেই ধাঁধাঁটাই তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল মরিয়মের খুদে মনে।
তবে মরিয়মের কথায়, তাঁর জীবনে রোয়ার মতো বন্ধুর জায়গাও অপরিসীম। হাইস্কুলে প্রথম সপ্তাহেই আলাপ হয়েছিল রোয়ার সঙ্গে। সে বন্ধুত্ব আজও অটুট। রোয়া এখন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন। মরিয়ম-রোয়াদের স্কুলটার গা ঘেঁষেই ছিল বিশাল বইপাড়া। স্কুল শেষের পর ওই দিকটা এক বার ঢুঁ না মেরে কিছুতেই বাড়ি ফিরতেন না দু’জনে। সেখানেই মরিয়মদের হাতে চলে এসে পড়েছিল জাতীয় গণিত প্রতিযোগিতার পুরনো প্রশ্নপত্র। সেই প্রতিযোগিতায় জিতলেই ‘ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ইন ইনফরম্যাটিক্স’-এ ইরানের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার পথ খুলে যায়। দুই বন্ধু তিনটে অঙ্কের সমাধান করে ফেলেন। জেদ চেপে যায় তখনই। দু’জনে সোজা চলে গিয়েছিলেন প্রিন্সিপালের কাছে। মরিয়ম বললেন “প্রিন্সিপাল জানতেন, ইরান থেকে অলিম্পিয়াডে কখনও মেয়েদের পাঠানো হয় না। তবু ফিরিয়ে দেননি ছাত্রীদের। তাঁদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, হয়তো তোমরাই প্রথম করে দেখাবে।”
প্রিন্সিপালের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে বছর সতেরোর মরিয়ম ও রোয়া ইরানের অলিম্পিয়াড দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। দেশের জন্য নিয়ে এসেছিলেন সোনা। মরিয়মের ফিল্ডস জয়ের খবরে তাঁর এক ফরাসি বন্ধু বললেন, “মেয়েটা হাবেভাবে এখনও সেই ১৭ বছরেরই আছে। জটিল অঙ্ক দেখলেই ওঁর চোখদু’টো চকচক করে ওঠে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy