Advertisement
E-Paper

দখলমুক্ত করাচির বিমানবন্দর, হত ২৯

সোমবার ভোর। করাচির জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে তখন বের আনা হচ্ছে একের পর এক নিথর দেহ। দশ জঙ্গির দেহ এক দিকে রাখা। বাকিদেরটা কিছু দূরত্বে। আর এক দিকে জড়ো করা হয়েছে জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সব অস্ত্র। রাতভর সংঘর্ষের পর জয়। তা-ও বিষণ্ণ সেনাদের মুখ। কারণ বিমানবন্দরকে জঙ্গিমুক্ত করতে গিয়ে খোয়াতে হয়েছে ১৯টি প্রাণ। সারা রাত ধরে সংঘর্ষের পর সোমবার সকালে পাক সেনা ঘোষণা করেছে, হামলাকারী ১০ জঙ্গিই নিহত।

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৪ ০৩:৩৩
তখনও রণক্ষেত্র। আকাশ ঢেকেছে আগুন আর ধোঁয়ায়। রবিবার রাতে করাচি বিমানবন্দরে। ছবি: এপি

তখনও রণক্ষেত্র। আকাশ ঢেকেছে আগুন আর ধোঁয়ায়। রবিবার রাতে করাচি বিমানবন্দরে। ছবি: এপি

সোমবার ভোর। করাচির জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে তখন বের আনা হচ্ছে একের পর এক নিথর দেহ। দশ জঙ্গির দেহ এক দিকে রাখা। বাকিদেরটা কিছু দূরত্বে। আর এক দিকে জড়ো করা হয়েছে জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া সব অস্ত্র।

রাতভর সংঘর্ষের পর জয়। তা-ও বিষণ্ণ সেনাদের মুখ। কারণ বিমানবন্দরকে জঙ্গিমুক্ত করতে গিয়ে খোয়াতে হয়েছে ১৯টি প্রাণ।

সারা রাত ধরে সংঘর্ষের পর সোমবার সকালে পাক সেনা ঘোষণা করেছে, হামলাকারী ১০ জঙ্গিই নিহত। সেই সঙ্গে মারা গিয়েছেন বিমানবন্দরের ১১ জন নিরাপত্তারক্ষী, দুই রেঞ্জার অফিসার, এক পুলিশ অফিসার এবং পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার চার কর্মী। মোট নিহতের সংখ্যা ২৯। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অন্তত ২৬ জন।

তবে যাত্রীদের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে এ দিন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে পাক সরকার। শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি একটি বিমানও। সে দিক থেকে জঙ্গিদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিতে পেরেছে পাক সেনা। সোমবার বিকেল থেকে করাচি বিমানবন্দর স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে গিয়েছে।

সোমবার সকালেই এই হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল তেহরিক-ই-তালিবান। মুম্বই হামলার মূল চক্রী হাফিজ সঈদ আবার আঙুল তুলেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দিকে। একাধিক টুইটে তার দাবি, করাচি বিমানবন্দরে এই হামলার পিছনে হাত রয়েছে মোদীর নতুন নিরাপত্তারক্ষী দলেরই।

পাক পুলিশ জানাচ্ছে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীদের পোশাক পরে ঢুকেছিল জঙ্গিরা। বেছে নিয়েছিল করাচি বিমানবন্দরের এক নম্বর টার্মিনালকে। মূলত পুণ্যার্থীদের যাতায়াতের বিমান, কিছু ব্যক্তিগত বিমান এবং মাঝেমধ্যে দু’একটি সরকারি বিমান ছাড়া পুরনো এই টার্মিনালটি এখন নিয়মিত ব্যবহার করা হয় না। জনবিরল হওয়ার দরুণ ওই টার্মিনালটিই তাই প্রবেশপথ হিসেবে বেছে নিয়েছিল জঙ্গিরা। ২০১১ সালে করাচি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হানার পর এত বড় আকারের হামলা আর হয়নি।

রবিবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ তারের বেড়া কেটে যখন ওই ১০ জন যখন টার্মিনালের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল, তখনই তাদের লক্ষ করেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। শুরু হয় গোলাগুলি। চার জন নিরাপত্তা রক্ষীকে মেরে ভিতরে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। এর পর পাঁচ জনের দু’টি দলে ভাগ হয়ে গিয়ে তারা আশ্রয় নেয় টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের নিকটবর্তী দু’টি হ্যাঙ্গারে। একটিতে ছিল অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিমানগুলি। তার ডান দিকেই ইস্পাহানি হ্যাঙ্গার। যেখানে মূলত বড় বিমানগুলির রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে।

তত ক্ষণে বিমানবন্দরে শুরু হয়ে গিয়েছে পুলিশি তৎপরতা। গাড়ির পর গাড়ি বোঝাই করে পৌঁছে গিয়েছে জঙ্গি মোকাবিলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী। আনা হয়েছে আধা-সামরিক বাহিনীকেও। গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তান রেঞ্জার্স। কিছু সময় পরই লুকিয়ে থাকা এক জঙ্গি আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় বিমান-জ্বালানি মজুত করে রাখা একটি হ্যাঙ্গারে। মুহূর্তে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে পোড়া জ্বালানির গন্ধে।

এর পরের পাঁচ-ছয় ঘণ্টা খালি গুলি আর বিস্ফোরণের আওয়াজ। ভোরের আলো ফোটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাক বাহিনী জানিয়ে দেয়, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে। অপারেশন শেষ হতে প্রায় ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে যায়। হামলাকারীদের মধ্যে তিন জন মারা গিয়েছে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে। বাকি সাত জন সেনার গুলিতে। গুলিযুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরে আটকে পড়া বিমানকর্মীদের বের করে আনে সেনা। তাঁদের চোখে-মুখে তখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। এক বয়স্ক কর্মী কোনও মতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জানান, গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে একটি শৌচাগারে লুকিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা কয়েক জন। ভাবতে পারেননি প্রাণে বেঁচে যাবেন এ যাত্রা।

এই জঙ্গিদের কী উদ্দেশ্য ছিল তা নিয়েও এখনও ধন্দ কাটেনি। একটি বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেছেন, পুরনো টামির্নালের কাছে রাখা বিমানগুলিকে নষ্ট করে দেওয়াই ছিল হামলাকারীদের মূল লক্ষ্য। মূলত দেশের বিমান শিল্পের বুকে বড়সড় আঘাত হানারই পরিকল্পনা করেছিল তারা। যদিও অন্য একটি মহলের মত, বিমান ছিনতাই করে সম্ভবত ৯/১১-র মতো কোনও হামলার পরিকল্পনা ছিল ওই জঙ্গিদের।

তালিবানের মুখপাত্র শাহিদুল্লা শাহিদ এ দিন জানিয়েছেন, তালিবান নেতা হাকিমুল্লা মেহসুদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা। গত নভেম্বরে ওয়াজিরিস্তান এলাকায় মার্কিন বাহিনীর ড্রোন হামলায় নিহত হন মেহসুদ। তাঁর আরও হুমকি, “এ তো সবে শুরু। এখনও আরও অনেকের মৃত্যুর বদলা নেওয়া বাকি রয়েছে। আমাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রতিশোধ নিতে আমরা যে এখনও বেঁচে রয়েছি, সেই কথা সরকারকে মনে করিয়ে দিতেই এই হামলা।” বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তালিবানের মূল নিশানা পাক সেনা এবং প্রশাসন। সে কথা মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষের থাকার সম্ভাবনা কম, এমন জায়গায় হামলা চালিয়েছে তারা।

ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর)-এর ডিরেক্টর জেনারেল মেজর আসিম বাজওয়া জানান, সোমবার বেলা দু’টো থেকেই জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে বিমানবন্দর। তার পরই প্রধানমন্ত্রীর অসামরিক বিমান বিষয়ক উপদেষ্টা শুজাত আজিম বিকেল চারটে থেকে বিমান চলাচল শুরু করার কথা ঘোষণা করেন। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে মিলেছে একটি এক্স-স্ট্যাট ডিভাইস। আধা সামরিক বাহিনীর এক সূত্রের ব্যাখ্যা, এই ধরনের যন্ত্র মুহূর্তের মধ্যে থামিয়ে দিতে পারে রক্তপাত। গুলির ক্ষত নিরাময় করতে পারে ১৫-২০ সেকেন্ডের মধ্যে। এ ছাড়াও তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও তিনটি রকেট লঞ্চার, পাঁচটি সুইসাইড জ্যাকেট, ১৫টি পেট্রোল বোমা এবং পাঁচটি সেমি-মেশিনগান।

জঙ্গিদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহিদদের প্রতি এ দিন শ্রদ্ধা জানিয়েছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী চৌধুরি নিসার আলি খান। তাঁদের সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শরিফ এবং প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেন। তবে তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খান শরিফ সরকারের সমালোচনা করেন। তাঁর কথায়, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় সরকার যে কার্যত ব্যর্থ, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট।

nawaz sharif taliban terrorist attack karachi airport
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy