Advertisement
E-Paper

‘জেনারেল নিয়াজিকে নিয়ে পালাত, রেঙ্গুনের প্লেনটা আমরা আটকে দিলাম’

এ যেন এরিক মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। সৈনিকের যুদ্ধদিনের কথা। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, রণাঙ্গণ একাত্তর ফিরে ফিরে এল ঢাকায়। বাংলাদেশ আর ভারতের সেই যুদ্ধদিনের সৈনিকরা শোনালেন, যা শোনা হয়েছে কিংবা যা শোনা হয়নি, সেই ইতিহাস।

অঞ্জন রায়

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৯:১৫
—নিজস্ব চিত্র

—নিজস্ব চিত্র

এ যেন এরিক মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। সৈনিকের যুদ্ধদিনের কথা। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, রণাঙ্গণ একাত্তর ফিরে ফিরে এল ঢাকায়। বাংলাদেশ আর ভারতের সেই যুদ্ধদিনের সৈনিকরা শোনালেন, যা শোনা হয়েছে কিংবা যা শোনা হয়নি, সেই ইতিহাস।


বাংলাদেশের একটি ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল এবং ঢাকাযর ভারতীয় হাই কমিশনের যৌথ আয়োজনে রাজধানীর কুর্মিটোলায় আর্মি গলফ কোর্সের পামভিউ রেস্টুরেন্টে এই আসর বসেছিল। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আসা ভরতীয় মিত্র বাহিনীর ২৮ সেনাকর্তা আর তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে যুদ্ধ করা এই দেশের সেনাদের উপস্থিতিতে এক নস্ট্যালজিক পরিবেশ।

দীর্ঘ নয় মাস মুক্তির সংগ্রাম করে যে বিজয় অর্জন তার গল্প এখন অনেকেরই জানা। কিন্তু অজস্র ঘটনার মধ্যে থেকে গেছে আরও অনেক অজানা গল্প। ক্লাবের খোলা বারান্দায় হাজির হয়েছিলেন যোদ্ধারা। ছিলেন দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও। অনুষ্ঠানটি মূলত মিডিয়া ইন্টারঅ্যাকশন। ফলে সাংবাদিকরাই এর প্রধান শ্রোতা।

# ৪৫ বছর পর দেখা...

১৯৭১ সালের রণাঙ্গণে কোনও এক বাঙ্কারে বসে দেখা হয়েছিল দুই সহযোদ্ধার। ভিন্ন দেশের হলেও তখন দুজনই একটি দেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন। ৪৫ বছর পর আবার ওই দুই সহযোদ্ধার সাক্ষাৎ। সেই স্বাধীন দেশেই।
দুজনই এসেছেন যুদ্ধ জয়ের সেই গল্প শোনাতে। অকুতোভয় এই দুই যোদ্ধা হলেন, বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদ বীরপ্রতীক এবং ভারতের প্রাক্তন সেনাকর্তা কর্নেল এমএম রবি। দীর্ঘকাল পরে এই সাক্ষাতে আবেগী হয়ে পড়েন দুজনই। কর্নেল এমএম রবি পরিচয় পর্বের সেই গল্প শোনানোর দায়িত্ব তুলে দিলেন অপেক্ষাকৃত অনুজ হারুন অর রশিদের উপর।
বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনাপ্রধান শোনান কী ভাবে যুদ্ধকালে কঠিন সময়ে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা এমএম রবি। কী ভাবে অস্ত্র দিয়ে সাহস যুগিয়েছিলেন শূন্য হাতে থাকা বাংলাদেশের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে।
স্মৃতিচারণ করে হারুন অর রশিদ বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় আমাদের কাছে অস্ত্র গেলাবারুদ কমে আসে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া এলাকায় থাকা ক্যাম্পে আমরা ছিলাম অস্ত্র ছাড়া। এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের অদূরে থাকা ভারতীয় বাহিনীর ১০ নম্বর বিহার ক্যাম্পে যাওয়ার। এক দিন সেখানে গিয়ে কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেখানে যাওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর লোক পরিচয় দিলেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরে আমাকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর এমএম রবি এলেন এবং আমাকে বেটা সম্বোধন করে জানতে চাইলেন কী চাই আমাদের। সেই থেকে শুরু। ২/৩ দিন সময় নিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায়।”
এরপর একে একে আগরতলা এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে শুরু করে এমএম রবির আরও নানা সহযোগিতার কথা শোনালেন বীরপ্রতীক হারুন অর রশিদ।

# সিহোতা শোনালেন মানুষের ভালোবাসার কথা


“বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ অনেক কারণেই মহান হয়ে আছে। এখানে আমরা অনেক কিছুই দেখেছি, এ দেশের মানুষের সাথে মিশে অনেক মানবতার ঘটনাও চাক্ষুস করেছি। যা আমাদের আজও মনে আছে।” কথা বলছিলেন ভারতীয় সেনার প্রাক্তন কর্তা লেঃ জেনারেল জিএস সিহোতা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কোথায় নদী পার হতে গিয়ে মাঝির সাহসী সহযোগিতা পেয়েছিলেন, কোথায় গ্রামের ভেতরে সাধারণ মানুষ তাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, কোথায় কে খাবার দিয়েছিলেন সেসব স্মৃতিও তুলে ধরেন তিনি।
সিহোতা বলেন, বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের হামলা ছিল যেমন মানবতার বিরুদ্ধে তেমনি বাংলাদেশিদের মানবিক আচরণ আমাদের মুগ্ধ করেছিল। একজন গণক, একজন মাঝি, একজন গৃহস্থ কীভাবে তাদের সতর্ক করেছিলেন তা জানান সিহোতা।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে তার বেঁচে আসার কাহিনীও বর্ণনা করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন (এয়ার অপারেশন পাইলট)।
মেঘনা ব্রিজ পাকিস্তানি বাহিনী ভেঙে দেওয়ার খবর শুনে হেলিকপ্টার নিয়ে সেখানে যান। বুলেট হামলা চলছিল। হেলিকপ্টারে একের পর এক বুলেট আঘাত করতে থাকে। তার মধ্য থেকেই তিনি হেলিকপ্টার চালিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া একটি দেশ এই বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতিতে খুশি এই ভারতীয় যোদ্ধা। বলেন, “এ দেশের এগিয়ে যাওয়া আমাদের মুগ্ধ করে।”

# রেঙ্গুন থেকে আসা প্লেন আকাশ থেকেই ফিরে যায়....

জিপি ক্যাম্পেন হেমন্ত সরদেশাই ছিলেন ৪নং সেক্টরে। ভারতের গুয়াহাটি থেকে তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে তাঁর সেরা যুদ্ধ ছিল ঢাকার কুর্মিটোলায়। তবে তাকে আজও যে স্মৃতি শিহরিত করে তা হচ্ছে, তিনি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজির পলায়ন।
হেমন্ত সরদেশাই বলেন, রাতেই খবর এলো রেঙ্গুন থেকে একটি প্লেন এসে জেনারেল নিয়াজিকে নিয়ে যাবে। সেটি অবতরণ করবে তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়েতে। তাঁর দায়িত্ব হল নিয়াজি যাতে কোনও ভাবেই পালাতে না পারেন। সে লক্ষ্যে দায়িত্ব নিয়ে হেমন্তের নেতৃত্বে সকাল থেকেই শুরু হয় বোমা হামলা।
হেমন্ত বলেন, ছোট্ট রানওয়ে, ঘন কুয়াশা। তার মধ্যে এই হামলা ছিলো খুবই বিপজ্জনক। কিন্ত তাঁরা পিছপা হননি। একের পর এক বোমা ফেলতে থাকেন রানওয়ের ওপর। ফলে রেঙ্গুন থেকে আসা প্লেন আকাশ থেকেই ফিরে যায়।

# আমরা মিত্র বাহিনী আছি, থাকবো....

যুদ্ধ জয় হলো। এবার যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পালা। ব্রিগেডিয়ার ভানত মদন মোহন সে দায়িত্ব নিয়ে গেলেন চট্টগ্রামে। সব হারানো মানুষকে দেখলেন। তাদের পাশে দাঁড়ালেন। চট্টগ্রামের মানুষও তাদের আস্থার জায়গায় স্থান দিলেন। সেই ইতিহাস তুলে ধরে ব্রিগেডিয়ার ভানত মদন বললেন, “আমরা তোমাদের মিত্রবাহিনী ছিলাম, মিত্রবাহিনী থাকবো।”

আরও পড়ুন: স্বাধীনতার যুদ্ধে ঢাকাকে পাশে চান বালুচ নেতা

আরও পড়ুন: অনেক রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা, লাল-সবুজ আবেগে ভাসছে বাংলাদেশ

Indian Soldiers Bangladeshi Freedom Fighters Bangladesh War Bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy