Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Business News

নীরবরা পালান, আর আমরা আগাম ঋণ ফেরত দিতে গেলে পেনাল্টি হয়

ব্যাঙ্কগুলোকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলে যে ঋণ গ্রাহক সময় সীমার আগে লোন ফেরত দিলে, ব্যাঙ্কদের লোকসান হয় সুদের ক্ষেত্রে। তাই, পেনাল্টি লাগানো হয়েছে যাতে লোকসানের কিছু বা পুরো ক্ষতিপূরণ গ্রাহকের থেকে নেওয়া যেতে পারে।

বেসরকারি বা সরকারি ব্যাঙ্ক যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের জন্যে নিয়ম সব সময় কঠিন। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

বেসরকারি বা সরকারি ব্যাঙ্ক যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের জন্যে নিয়ম সব সময় কঠিন। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

কুমার শঙ্কর রায়
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৮ ১৮:৪২
Share: Save:

ভারতীয় ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে দশ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ আছে, যা বড় বড় শিল্পপতি বা বিখ্যাত গোষ্ঠীরা ফেরত দেয়নি। সুতরাং, ব্যাঙ্কের লোকসান। এ রকম বিপুল অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে কেন এমন হল, জিজ্ঞেস করলে বলা হয়— অর্থনৈতিক মন্দা এবং ব্যবসায়িক সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি। রাজনৈতিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হোন বা না হোন, ধনী ব্যবসায়ীরা বেশ ভাল ফন্দি এঁটেছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে, অনায়াসে। তাঁদের ধরতে পারা তো দূরের কথা, তাঁদের সম্পত্তি দখল করে টাকা উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়!

কিন্তু বিজয় মাল্য, নীরব মোদীর মতন বিবেকহীন ধনী ঋণ গ্রাহকদের দেশে, আমার আপনার মতন সাধারণ মানুষ আগাম ঋণশোধ করতে গেলেই জরিমানা! হ্যাঁ, লোন আগাম ফেরত দিতে যান, তখন সেই ক্ষমতাশূন্য এবং অকর্মণ্য সিস্টেমটাই আপনার উপর চাপায় পেনাল্টি। যেন, আপনাকে ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে— সময়ের আগে ঋণ ফেরত দেওয়া মহাপাপ।

আজব ব্যাপার

বেসরকারি বা সরকারি ব্যাঙ্ক যাই হোক না কেন, সাধারণ মানুষের জন্যে নিয়ম সব সময় কঠিন। সাধারণ মানুষ বলছি, কারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে লোন নেওয়া এবং ফেরত দেওয়া দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অনেকেই যত দিন ঋণ ফেরত দিতে না পারেন, মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকেন। এটাই আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি। কারণ ঋণ মানে নিজের টাকা নয়। এই সাধারণ মানুষ সংখ্যায় অনেক, এবং এঁরা কেউ ১০ বা ১০০ কোটি টাকার ঋণ নেন না।

আরও পড়ুন
কোছরের বিরুদ্ধে তদন্তে আমেরিকা

পার্সোনাল লোন নিতে হয় যখন মানুষের নানা বিপদ বা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। হাসপাতালের খরচ, পরিবারে হট করে বিয়ে, ছোট দোকান খোলা বা ইত্যাদির জন্যে লোন আবশ্যক। এই পার্সোনাল লোনে দিতে হয় ১১-১৮ শতাংশ বার্ষিক সুদ (ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে আমরা পাই মাত্র ৬-৭.৫ শতাংশ), তার পর ব্যাঙ্কের ঋণ বলে বুকের উপর একটা মস্ত চাপ থাকেই। ঋণ মুক্ত হতে গেলেও নানান উটকো ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু সব থেকে কষ্ট হয় যখন সাধারণ মানুষকে বিনা কারণে দণ্ড দেওয়া হয় 'প্রি-পেমেন্ট' পেনাল্টির নাম করে।

ভাগ্যের কি বিদ্রূপ দেখুন। বিজয় মাল্য, নীরব মোদীর মতন মানুষরা আমানতকারীদের টাকা এক রকম চুরি করে এত পুলিশ, সিবিআই থাকতেও প্লেনে করে সাঁ সাঁ করে চলে গেলেন। লন্ডনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছেন, আনন্দে দিন-রাত কাটাচ্ছেন। অথচ, সাধারণ মানুষ পার্সোনাল লোন, গাড়ির লোন বা গোল্ড লোন আগাম ফেরত দিতে গেলেই, ব্যাঙ্ক কার্যত বুঝিয়ে দিচ্ছে— আগাম টাকা ফেরত দিয়ে ঋণ-মুক্ত হওয়া ঠিক কাজ নয়। এই দ্বিচারিতা মেনে নেওয়া কঠিন!

পেনাল্টি কেন

মজার ব্যাপার হল বাড়ির লোনের জন্যে আগে 'প্রি-পেমেন্ট' পেনাল্টি ছিল। কিন্তু আরবিআই কিছু বছর আগে তা সরাতে বলে। কিন্তু অন্য অনেক লোনের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে এই অদ্ভুত পেনাল্টি সিস্টেম। ভাল ভাবে দেখলে বোঝা যাচ্ছে, এমন কোনও ঋণ যা কোনও সম্পদ দ্বারা সুরক্ষিত নয় (মানে আনসিকিউরড লোন), তার উপর এই 'প্রি-পেমেন্ট' পেনাল্টি লাগানোর ক্ষমতা আছে ব্যাঙ্কদের। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গাড়ির লোন বা গোল্ড লোন হলেও লাগতে পারে 'প্রি-পেমেন্ট' পেনাল্টি, যদি আগাম ফেরত দিতে যাওয়ার 'ভুল' করেন।

ব্যাঙ্কগুলোকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলে যে ঋণ গ্রাহক সময় সীমার আগে লোন ফেরত দিলে, ব্যাঙ্কদের লোকসান হয় সুদের ক্ষেত্রে। তাই, পেনাল্টি লাগানো হয়েছে যাতে লোকসানের কিছু বা পুরো ক্ষতিপূরণ গ্রাহকের থেকে নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, এক বেসরকারি ব্যাঙ্ক পার্সোনাল লোনের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ (এবং তার উপর জিএসটি) পেনাল্টি হিসাবে নেয়। তা ছাড়া, দেশের সব থেকে বড় বেসরকারি ব্যাঙ্ক লোন নেওয়ার ১২ মাস পরে (১২টি ইএমআই দেওয়ার পর) বাকি ঋণের পুরো টাকা আগাম দিতে দেয়। তার আগে নয়। কিন্তু আগাম ঋঁশোধের এই 'অন্যায়ের' জন্যে আপনাকে জরিমানা দিতে হবে ২-৪ শতাংশ। আংশিক পেমেন্ট দিতে দেবে মূল টাকার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত, কিন্তু এটি শুধুমাত্র একবার একটি আর্থিক বছরে করতে দেওয়া হয় এবং ঋণের মেয়াদে সর্বাধিক দু’বার করতে পারেন।

আরও পড়ুন
ব্যাঙ্ক চাঙ্গায় দাওয়াই গয়ালের

গাড়ির লোনের ক্ষেত্রে ৬ মাস পর থেকেই আগাম ফেরত দেওয়া যায়, কিন্তু অন্যায্য পেনাল্টি আছেই। আংশিক ভাবে টাকা ফেরত দিলে ৩-৬ শতাংশ চার্জ দিতে হবে। একেবার ঋণের টাকা আগাম ফেরত দিলে ৫-১০ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ লাগাচ্ছে কিছু ব্যাঙ্ক। একটি ব্যাঙ্ক গাড়ির লোন নিয়ে ১৮০ দিনের পরে আংশিক ভাবে ঋণ ফেরত দিতে চাইলে ৫ শতাংশ চার্জ চাইছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। ১৮০ দিনের মধ্যে ফেরত দিতে চাইলে দিতে হবে ১০ শতাংশ! পুরো ঋণ একবারে ফেরত দিতে (ফোরক্লোজার) চাইলে প্রিন্সিপালের (মূল ঋণ অঙ্কের) ৫-১০ শতাংশ চার্জ হিসাবে নেবে ব্যাঙ্ক। এ ছাড়া, জিএসটি দিতেই হবে যেখানে প্রযোজ্য।

গোল্ড লোন নিলেও নিস্তার নেই। সোনা বন্ধক রেখে মানুষ কি ধেই ধেই করে ঋণ নিতে যায়? যায় না। বিশাল বিপদে না পড়লে সোনা বন্ধক কেউ রাখে না। কিন্তু সেই ঋণ ফেরত দিতে যান, গেলেই বুঝবেন। আগাম গোল্ড লোন দিতে গেলেই ১ শতাংশ চার্জ নেবে। তার পর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার জন্যে ১ শতাংশ অতিরিক্ত নেবে যদি গোল্ড লোন এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ফেরত দিয়ে ফেলেন। কিছু গোল্ড লোন কোম্পানি 'প্রি-পেমেন্ট' পেনাল্টি উঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কয়েকটি ব্যাঙ্ক এখনও নানান ভাবে চার্জ লাগাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE