সুজাতা বাজপেয়ী
একটি কিডনি নেই। তিন বছরের নাতনিকে কোলে নিয়ে সেই অবস্থাতেই এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রৌঢ়া। প্রশ্ন করলে বলছেন, ‘‘হাতে আর মাত্র ছ’দিন। তার মধ্যেই নতুন থাকার জায়গা খুঁজতে হবে। এখনকার ভাড়া বাড়িতে থাকার মেয়াদ ওই পর্যন্তই। নাতনিকে নিয়ে যাব কোথায়?’’ এই তাড়নায় মেয়ের খোঁজও আপাতত থামিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রৌঢ়ার বক্তব্য, মেয়ে হয়তো আর বেঁচেই নেই। পুলিশ দেখুক। নাতনিটাকে তো বড় করতে হবে!
গত ১৮ ডিসেম্বর বন্ধু অভিষেক সাউয়ের সঙ্গে তাঁর মেয়ে সুজাতা বাজপেয়ী গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছেন বলে প্রৌঢ়া অপর্ণা ভারতীকে জানিয়েছে পুলিশ। তার পর থেকে বছর পঞ্চাশের অপর্ণদেবীর কাছেই রয়েছে সুজাতার তিন বছরের শিশুকন্যা।
মেয়ের অবর্তমানে এখন নাতনিকে নিয়ে কোথায় থাকবেন, সেটাই বড় চিন্তা অপর্ণাদেবীর।
মেয়ে সুজাতা, তাঁর স্বামী রাজেশ বাজপেয়ী এবং তাঁদের তিন বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে অপর্ণাদেবীরা আগে থাকতেন ইলিয়ট রোডে। তবে সেই বাড়িতে নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা। বাড়িওয়ালা তাঁদের অন্য কোথাও থাকার জায়গা দেখে নিতে বলেন। ওই মাসেই জামাই রাজেশ তাঁদের ছেড়ে চলে যান বলে অভিযোগ অপর্ণাদেবীর। সেই সময়ে মেয়ের বন্ধু অভিষেকের সাহায্যেই তাঁরা মল্লিকবাজারের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। গত ২৫ নভেম্বর থেকে সেই বাড়িতে এক মাসের জন্য ভাড়া থাকতে দেওয়া হয় অপর্ণাদেবীদের। আগামী ২৫ তারিখ মেয়াদ শেষ হচ্ছে। অনুরোধ করে আরও পাঁচ দিন ওই বাড়িতে থাকার সময় পেয়েছেন অপর্ণাদেবীরা। এর মধ্যেই সুজাতা এবং অভিষেক নিখোঁজ হয়ে যান। পুলিশ অপর্ণাদেবীকে জানায়, তাঁরা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছেন। রবিবারও তাঁদের খোঁজ মেলেনি। তাঁর মেয়ের খোঁজ আদৌ মিলবে কি, এখনও কোনও আশার আলো দেখছেন না অপর্ণাদেবী।
পুলিশও এ ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নয়। এক পুলিশ আধিকারিক জানান, কোনও কোনও ক্ষেত্রে গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার কিনারা করতে বছর পেরিয়ে যায়। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, গঙ্গার মাঝের অংশের গভীরতা বেশি। সেই জায়গা দিয়ে মূলত জাহাজ চলাচল করে। ওই অংশে জলের টানও বেশি থাকে। সেখানে কোনও ভাবে দেহ গেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন। উদাহরণ হিসেবে উঠে আসছে, কলকাতার গঙ্গায় ভাসমান একটি হোটেলের কর্তার জলে তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা। অরিন্দম বসু নামে ওই কর্তা চলতি বছরের গোড়ায় গঙ্গায় পড়ে যান। এখনও তাঁর খোঁজ মেলেনি। পশ্চিম বন্দর থানার পুলিশ জানাচ্ছে, উলুবেড়িয়ার ৫৮ নম্বর গেটের কাছে একটি ভাড়া করা লঞ্চে সহকর্মীদের সঙ্গে পিকনিক করতে যান অরিন্দমবাবু। লঞ্চে মোট ৩৫ জন ছিলেন। ওই দিন বিকেলে ফেরার পথে হাওড়ার নাজিরগঞ্জের কাছে অরিন্দমবাবু লঞ্চের সামনে সারেঙের কেবিনের দিকে যাওয়ার পথে জলে পড়ে যান। পরে অরিন্দমবাবুর স্ত্রী অদিতি বসু পশ্চিম বন্দর থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ এটিকে দুর্ঘটনা বললেও রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। মেলেনি কর্তার দেহও।
গত ফেব্রুয়ারিতেই হাওড়া ব্রিজের ৩০ নম্বর পিলারের কাছ থেকে মহম্মদ ইরফান নামে এক ব্যক্তি গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। মেটিয়াবুরুজের এই বাসিন্দার খোঁজও মেলেনি এ পর্যন্ত।
আশাহত অপর্ণাদেবী এখন বলছেন, ‘‘শুনেছি বহু ক্ষেত্রেই দেহ মেলে না। জানি না আমার মেয়ে আর ফিরবে কি না। শুধু নাতনিকে যেন কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে না নেয়। ওকে মানুষের মতো মানুষ করব।’’ মা-হারা শিশুকন্যাকেও দেখা গেল, কথা বলতে গেলেই লুকিয়ে পড়ছে দিদার কোলে।
এখন ওই কোলই হয়তো নিরাপত্তা খুঁজছে সে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy